[তৃতীয় খন্ড]
ধনী পরিবারে মেয়েদের স্বামীর বিকল্প হয়ে ওঠে কোনো দেবতা: রাধারণীর বিকল্প স্বামী হয় কৃষ্ণ, যার পুজোয় সে নিজেকে সমর্পণ করে। অনেক উপাখ্যানে দেখা যায় যে অবিবাহিত বালিকারা মেতে উঠেছে পুজোয়, বিশেষ ক’রে কৃষ্ণের পুজোয়। অবিবাহিত বালিকাদের মন্দির নিয়ে মেতে ওঠার, বিশেষ ক’রে কৃষ্ণের পুজোয় নিজেদের বিলিয়ে দেয়ার ভেতরে লুকিয়ে আছে এক গোপন তাৎপর্য: কৃষ্ণ চরিতার্থ করে তাদের কাম; কৃষ্ণপ্রেমের ভেতর দিয়ে তারা জানায় তাদের পুরুষ ও স্বামীবিদ্বেষ।
এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন রাধারাণী বলে, ‘আমার কৃষ্ণ ত দিনরাত্তির আমার কাছেই রয়েছেন, … তোরা তোদের স্বামীকে কি এমন করে সাজাতে পারিস? না, এমন ভালই বাসতে পারিস? তারা পান থেকে চুণ খসলে ঝগড়া করে, দাসীর মত খাটিয়ে নিয়ে দুটো ভাল কথাও সকল সময় কয়ে উঠতে ফুরসৎ পায় না … আমি তাই স্বয়ম্বর হয়েছি। ’ যেনো সব নারীর মতোই তার জানা আছে পুরুষের পাশবিকতা, তাই পুরুষকে প্রত্যাখ্যান ক’রে গ্রহণ করে সে কৃষ্ণকে; বলে, ‘আমি যে প্রতিজ্ঞা করেছি, এ জন্মে বিবাহ করিব না। ’
নারীর একমাত্র একান্ত সম্পদ তার দেহ, যার প্রতি পুরুষের একমাত্র মোহ। নারীর পুরুষবিরোধিতার একটি রূপ হচ্ছে সে তার দেহটিকে রক্ষা করতে চায় পুরুষের গ্রাস থেকে; সে বোধ করে তার দেহটি যদি পুরুষের কবলে পড়ে তখন তার আর নিজের বলে কিছু থাকে না। তার দেহ নষ্ট হয়, সেও নষ্ট হয়। নারী তখন হয়ে ওঠে কামবিরূপ, কামশীতল। এটাও নারীর এক বড়ো বিদ্রোহ। রাধারাণী জানে তার দেহটি তুলে দিতে হবে পুরুষের ক্ষুধার কাছে; তার পিতামহ যে-দলিল ক’রে যায়, তা হচ্ছে পুরুষকে দেহদানের অনিবাৰ্য নির্দেশ। তার জীবনের করুণ পরিহাস।
‘তাহার দেবোদ্দেশ্যে উৎসৰ্গিত মনঃপ্রাণ কোন এক ক্ষুদ্র মানব চরণে উৎসর্গ করিছে হইবে। শ্ৰীকৃষ্ণ সমৰ্পিত এ জীবন যৌবন নরভোগ্য করিয়া তবেই এ আশৈশবের আশ্রয় ক্রয় করা। ’ কিন্তু তা সে চায় না, তার সাধ হয় : ‘এই ঐশ্বর্য সে জীর্ণ বস্ত্রখণ্ডের মত পরিত্যাগ করিবে সেও ভাল, তবু এ দেহ কাহাকেও দান করিতে পরিবে না।… কোথাকার কে একটা মানুষ! সে তাহার মালিক মোক্তার হইয়া বসিবো?’ অনুরূপা দেহের ওপর বেশ জোর দিয়েছেন, নারীদেহকে ‘নরভোগ্য’ হ’তে দেয়ার অর্থ ওই দেহকে দূষিত করা, এমন একটি মনোভাব তিনি জ্ঞাপন করেছেন।
বাণী বিয়ে করতে রাজি হয় এক শর্তেঃ যার সঙ্গে তার বিয়ে হবে, তার সঙ্গে সে একরাতও কাটাবে না। সে দেহ দিতে পারবে না পুরুষকে, দাসীত্ব করতে পারবে না। পুরুষের; সে বলে, ‘এই জন্যই বিবাহে বিতৃষ্ণা হয়। সাধ করে কি বলি, বিবাহের নামই দাসীত্ব। ’ তবে তার জীবনের ট্র্যাজেডি হচ্ছে নিজেকে সম্পদের মধ্যে রাখার জন্যে তাকে বিয়ে করতে হয় এমন একজনকে, যাকে সে একদিন বরখাস্ত করেছে মন্দিরের পুরোহিতের দায়িত্ব থেকে।
তার নাম অম্বরনাথ। অম্বরনাথের অবশ্য নায়কোচিত সব গুণ রয়েছে, যদিও সে দরিদ্র। বাণীর সংকট দুটি, সে পুরুষবিরূপ, এবং অম্বরনাথের ওপর বিরূপ; তবু ‘তাঁহারই মন্দিরের অযোগ্য পুরোহিত বলিয়া এই সে দিন মাত্র সে তাহাকে অক্ষমতার জন্য তিরস্কার করিয়া বিদায় দিয়াছে,-সেই ব্যক্তিরই পায়ে ধরিয়া তাহার পিতা তাহাকে দান করিবেন?–আর এই দেব-চরণে উৎসৰ্গিত শরীর,–তৎকর্তৃক লাঞ্ছিত সেই ভিখারীকেই সমৰ্পণ করিতে হইবে? বাণী ভাবিল, এ কথা শুনিবার পূৰ্ব্বে সে মরিয়া গেল না কেন?’
বাণী যে কামশীতল, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই; বাণী যে পুরুষকে দেহদানের কথা বার বার ভেবেছে, ঘেন্না বোধ করেছে দেহ দিতে. এটা তার পুরুষের বিরুদ্ধে চরম বিদ্রোহ। ‘সে বড় নিশ্চিন্ত ছিল যে, মানুষকে কোনমতেই সে বিবাহ করিবে না’, এবং সারা উপন্যাসে সে পুরুষকে তার দেহ দেয় নি। এক সময় ঔপন্যাসিক হস্তক্ষেপ করেন, তিনি যে-দিকে বাণীকে নিয়ে যেতে চান সে-দিকে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন; মানুষ তাকে যাতে রাজি করাতে পারে নি, সেখানে প্রকৃতি হস্তক্ষেপ করে : ‘মহাপ্রকৃতি রাধা স্মিতমুখে তিরস্কার করিয়া কহিলেন, ‘পাপিষ্ঠী! প্রকৃতি স্বয়ং পুরুষের দাসী, তুই এমন কি যে, ঠাকুরালী হইয়া থাকিবি,–দাসী হাইবি না?’
অতিপ্রাকৃতের সহায়তায় অনুরূপা পিতৃতন্ত্রে দীক্ষিত করতে থাকেন বাণীকে। কিন্তু বাণী তার দেহ রক্ষা করতে চায় পুরুষের কামকলুষ থেকে; তখন অশ্রুপরিপুত নেত্ৰে যুক্তপাণি বাণী দেবতার উদ্দেশ্যে কহিল, তুমি কি শুনিতেছ, আমি অন্য কাহাকেও স্বামী বলিয়া স্বীকার করিতে পারিব না? তুমি যদি আমার পণ না রাখ, আমি নিজেই রাখিব। যদি বিবাহ করিতেই হয়, করিব। কিন্তু এ দেহ প্ৰাণ যখন তোমায় দিয়াছি, তখন এ কেবল তোমারি থাকিবে। ’ শরীরই তার অমূল্য সম্পদ : ‘তাহার এ শরীরটাও সে অন্যের নিকট বেচিতে পরিবে না। ’ বাণী তার দেহশুচিতা রক্ষার যে-প্ৰয়াস চালিয়েছে, তা নারীর গভীর পুরুষ বিরূপতার প্রকাশ। অনুরূপার বাণী নিজের দেহটিকে দূষিত করতে চায় না, কেননা দেহই তার পবিত্রতম সম্পদ; কিন্তু পুরুষতন্ত্র নির্দেশ দিয়েছে এটিকে দূষিত করতে হবে পুরুষ দিয়ে। তাই পুরুষ হয়ে উঠেছে। ঘৃণার পাত্র, কেননা কাজ দূষণ।
কিন্তু পুরুষের সঙ্গে তাকে জড়িত হ’তে হয়, এবং বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সে দেখতে পায় নারীকে বন্দী করার কৌশল : ‘অম্বর যখন প্রথম দাড়াইয়াছিল, তখন অম্বরের উত্তরীয়ে গাঁটছড়া বাধা–কাজেই বাণীকেও সেই সঙ্গে বাধ্য হইয়াই দাড়াইতে হয়। সে অমনি ঘোর বিরক্ত হইয়া ভাবিল,–এই ত প্ৰভুত্ব আরম্ভ হইয়া গেল। দেখিতেছি!–উনি দাড়াইলে দাড়াইতে হইবে, চলিলে চলিতে হইবে। আমায় যেন কিনিয়া ফেলিয়াছেন। ’
অম্বরনাথ তার অযোগ্য, তাকে সে বিয়ে করেছে সম্পত্তি রক্ষার জন্যে; মহৎ অম্বরনাথও স্বামীর অধিকার দাবি না ক’রে রাজি হয়েছে তাকে উদ্ধার করতে; তবু বাণীর মনে হইতে লাগিল, আজ এ গৃহের সম্রাজী সে হইলেও এ ব্যক্তি তাহার প্রভু। তাহার উপর যেন ইহার একটা দখলীস্বত্ব জন্মিয়া গিয়াছে। ’ তার মনে জাগে হিন্দু নারীর মহাপ্রশ্ন : ‘হিন্দুর সব ভাল, কেবল এইটিই বড় মন্দ। বিবাহ করিতে হইবে। কেন,–এমন কঠোর নিয়ম, কেন? মেয়ে হইয়া জন্মিয়াছি বলিয়া এতই কি মহাপাতক করিয়াছি… যিনি আমারই অন্নে প্রতিপালিত হইবেন, তিনিই হইবেন আমার প্রভু?’
যে-বিয়েকে এতো ঘেন্না করে নারী, তাতেই বসতে হয় তাকে। বিয়ের পর বাণী মিলিত হয় নি। স্বামীর সাথে, তার স্বামী দেবতার অধিক মহত্ত্ব দেখিয়ে দূরে চ’লে গেছে। তবে অনুরূপা দেবী এরপর বাণী ও নিজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা ক’রে বাণীকে দীক্ষিত করতে থাকেন পিতৃতন্ত্রের বিধিবিধানে, স্বামীকে ক’রে তুলতে থাকেন দেবতা। তিনি ছক ভেঙেছেন শুধু ছকটিকে আরো শক্ত ক’রে নির্মাণ করার জন্যে। তিনি বাণীর মধ্যে ঢোকাতে থাকেন বেদমন্ত্র, তাকে ক’রে তুলতে থাকেন। মহাসতী : ‘বাণী গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিল।
হিন্দুর মেয়ে যে স্বামীর সহিত হাসিমুখে কেমন করিয়া জ্বলন্ত চিতায় পুড়িয়া বিচ্ছেদের শান্তি করিত আজ তাহা বুঝিলাম। এ যে কি অচ্ছেদ্য বন্ধন!… সেই যে কালমন্ত্র. সেই অনুজ্ঞার সম্মোহনবিদ্যা প্রভাবে লুপ্তচৈতন্যবৎ হইয়া পত্নী সেই দিনই পতির হৃদয়ে হৃদয়, চিন্তায় বাক্যে চিন্তা বাক্য সমস্তই সঁপিয়া দেয়; তাহার। আর স্বাতন্ত্র্য কিছুই বাকি থাকে না। ’ অনুরূপা বাণীর কানে বাজাতে থাকেন পিতৃতন্ত্রের গীতিকা : ‘তাহার কানের কাছে সেই মুহূৰ্ত্তে যেন বাজিয়া উঠিল, ‘স্ত্রীলোকের স্বামী ভিন্ন অন্য সুখ নাই, অন্য কামনা নাই, এমন কি, অন্য দেবতাও নাই।’–সে ঈষৎ শিহরিয়া উঠিল। এ কি মার কথা–না দেবতার আদেশ?’ এটা আসলে পিতৃতন্ত্রে দীক্ষিত অনুরূপার চক্রান্ত।
অনুরূপা বেদমন্ত্র দিয়ে বাণীকে পুরুষপুজোয় আগ্রহী ক’রে তোলেন : ‘যদি প্রতিমায় তাহার পূজা করি, তবে মানুষের মধ্যেই বা না করি কেন?’ লেখিকা বাণীকে ক্রমশ দীক্ষিত করতে থাকেন পিতৃতান্ত্রিক বিধানে, আলোর নামে তাকে ঠেলে দিতে থাকেন অন্ধকারে : ‘এইরূপে তাহার জীবনে একসঙ্গে দুইটী আলো জুলিয়া উঠিতেছিল,–নারীজীবনের সারধৰ্ম্ম পতিপ্ৰেম, অপরটি সকল প্রেমের সারা ভগবৎপ্ৰেম। ’ বাণীর মধ্যে তিনি জাগিয়ে তোলেন ছকবাঁধা এক নারীকে : ‘স্বামী স্ত্রীর গুরু কেন, আজ তাহা বুঝিতেছি। আর কে আমায় এমন করিয়া এ শিক্ষা দিতে পারিত?’
অনুরূপা কাজ করেছেন পুরুষতন্ত্রের চর হিশেবে; তিনি নারীকে প্রথম নিজের অধিকার দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে পরে বেঁধেছেন শেকলে, বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন নিজের লিঙ্গের সাথে। তার চক্রান্তে বাণী হয়ে ওঠে পুরুষের প্রিয় ছকবাঁধা নারী : সেই ভস্মমুষ্টি পরে পতিপ্রেমের অমৃত্যভিষেকে এবং নিৰ্ব্বাসিত অম্বরের মন্ত্রশক্তি তেজে তপঃপূত-চরিত্রা, ব্ৰহ্মচারিণী, স্নেহ প্রেম করুণার জীবন্ত মূৰ্ত্তি এক সতী নারীর প্রতিষ্ঠা করিল। ’ বাণী সমগ্ৰ নারীজাতিকে নিয়ে আত্মসমর্পণ করে স্বামী ও পিতৃতন্ত্রের পায়ে : ‘হ্যা, তোমার বাণী, তোমারই স্ত্রী, তোমারই দাসী, তোমারই সহধৰ্ম্মিনী। …আমি তোমায় অনেক কষ্ট দিয়েছি, তবু আমি তোমার স্ত্রী, তোমার শিষ্যা-তোমার দাসী। আমায় ক্ষমা করিবে না কি?’
যে-বাণী স্বামীর দেহও কখনো ছোয় নি, সে মৃত্যুর হাত থেকে স্বামীকে ফিরিয়ে আনার জন্যে অবতীর্ণ হয় সতীরূপে : ‘এ নূতন জন্মে মৃত্যুর কাছে তোমায় ভিক্ষা করে ফিরিয়ে নিয়ে তোমায় আমি আমার করব। পারব না? কেন পারব না? সাবিত্রী তার মৃত স্বামীকে বঁচিয়েছিলেন,–আর আমি পারব না?–কেন, আমি কি সতী স্ত্রী নই?’ বেদমন্ত্রদীক্ষিত এ-আধুনিক সতী তার স্বামীকে মৃত্যুর কবল থেকে ফিরিয়ে আনার জন্যে প্রয়োগ করে। এ-পদ্ধতি : ‘তাহার মনের মধ্যে কোথা হইতে এ প্রতীতি সুদৃঢ় হইয়া উঠিল, যে তাহা হইলেই সে তাহার এই মৃত-কল্প স্বামীকে বাচাইয়া তুলিতে পরিবে।
তাহার শোণিতোষ্ণতাহীন নীল শিরার উপর সে নিজের উষ্ণশোণিত প্রবাহিত ধমনী একাগ্রচিত্তে স্থাপন করিয়া রাখিয়াছিল, যেন সেই সঙ্গে কোন অদৃশ্য শক্তিবলে সে আপনার শরীর হইতে তপ্ত শোণিত ধারা তাহার অঙ্গে সঞ্চালিত করিয়া দিতেছে. সমস্ত ইন্দ্ৰিয়দ্বার এক সঙ্গে রুদ্ধ হইয়া গিয়াছিল। কেবল সেই সৰ্ব্বসমাহিত সতী চিত্তের সমুদয় শক্তিকে উদ্ধৃদ্ধ করিয়া সে তাহার মৃত্যুবৎ স্থির স্বামীর দেহে আপনার জীবন হইতে জীবনী-ধারা ঢালিয়া দিতে চাহিতেছিল। ’ বেদমন্ত্র চিকিৎসাপদ্ধতিতে সে সফল হয়েছে কিনা অনুরূপা দেবী তা বলেন নি, তবে তিনি সফলভাবে একটি নারীকে বিন্যস্ত করেছেন পিতৃতন্ত্রের ছকে। নারীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা ক’রে অনুরূপা অর্জন করেছিলেন জনপ্রিয়তা।
নিরুপমা দেবীর দিদি (১৯১৫) চেতনায় ও কাঠামোয় অনুরূপার মন্ত্রশক্তির সাথে অভিন্ন; এতেও প্রচার করা হয়েছে পিতৃতন্ত্রের বিধান। অনুরূপা ও নিরুপমা, দুজনেই, ব্যবহার করেছেন একই ছক : মন্ত্রশক্তিতে বাণী সারা উপন্যাস জুড়ে নিজের দেহ রক্ষা করেছে স্বামীর কবল থেকে, শেষে আত্মসমর্পণ করেছে মৃত স্বামীর পায়ে; দিদির সুরমাও স্বামীকে দেহ দেয় নি, কিন্তু উপন্যাসের শেষ পাতায় আশ্রয় নিয়েছে স্বামীর পায়ে।
তাদের উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়গুলো নারীর জন্যে প্রলোভন, মাঝের অধ্যায়গুলো নারীর বিরুদ্ধে চক্রান্ত, আর শেষ পৃষ্ঠাগুলো বিশ্বাসঘাতকতা। কালিগঞ্জের জমিদারকন্যা সুরমা দাসীর বিয়ে হয় মাণিকগঞ্জের জমিদারপুত্র ডাক্তার অমরনাথের সাথে। তারা একটি বাসর রাত কাটিয়েছিলো পরস্পরকে না ছুয়ে–যথারীতি পাকস্পর্শ ফুলশয্যা সমস্ত হইয়া গেল। অমরনাথ ফুলশয্যার দিন জড়সড়ভাবে কোন রকমে খাটের এক পার্শ্বে শুইয়া রাত কাটাইয়া দিল। তাহার লজ্জা করিতেছিল। কন্যাটি নিতান্ত ছেলেমানুষ নয়; তের-চৌদ্দ বৎসর বয়স হইতে পারে। ’
পরে আকস্মিকভাবে অমরনাথ বিয়ে করে অনাথ চারুলতাকে। সুরমা এজন্যে স্বামীকে ক্ষমা করে নি; স্বামীকে ছেড়ে দেয়া সম্ভব হয় নি তার পক্ষে, তবে স্বামীকে সে গণ্য করেছে পরপুরুষ হিশেবেই। বিষবৃক্ষ-এ কুন্দকে আত্মহত্যা করতে হয়েছিলো, দিদি যেনো তার উত্তর; চারুলতাকে আত্মহত্যা করতে হয় নি, বরং সে-ই উপভোগ করে অমরনাথের স্ত্রীর ভূমিকা। সুরমা হয় তার দিদি। অমরনাথ ও সুরমা এক বাড়িতে থেকেও কখনো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে আসে নি। নারীদের উপন্যাসে একটি লক্ষণীয় ব্যাপার স্বামী-স্ত্রীর দূরত্ব, এ-উপন্যাসে তা চরম রূপ নিয়েছে।
অমরনাথ চারুলতাকে বিয়ে করার পর তার পিতা তাকে ত্যাগ করতে চেয়েছে, কিন্তু সে পুত্র, তাকে ত্যাগ করা অসম্ভব; বরং তার পিতা মৃত্যুর আগে পুত্রবধু সুরমাকে দেবীর বেদিতে বসিয়ে উৎসর্গ ক’রে যায় সুরমার জীবনটি : ‘মা, আমি একে তোমার হাতে দিয়া গেলাম। এ তোমার ছোট বোন। ছোট-বীেমা, তোমার দিদিকে প্ৰণাম কর। ইনি দেবী। ’ সুরমা চরম ঘৃণায় মেনে নেয় দেবীর ছক, সে হয় এমন দেবী যে ঘৃণা করে স্বামীকে : ‘অমরকে যে তাচ্ছিল্য দেখাইয়া সে ফিরাইয়া দিতে পারিয়াছে, ইহা মনে করিয়া একটি বিজয়ানন্দে সুরমার হৃদয় পূর্ণ হইয়া উঠিল। ’
নিঃশব্দ বিরোধই হয়ে ওঠে তাদের জীবন। এতে অবশ্য অমরনাথের জীবনে কোনো শূন্যতা দেখা দেয় নি, সে চারুলতাকে নিয়মিতভাবে গর্ভবতী করেছে; চরম শূন্যতায় দিদির দেবী মহিমার জ্বালার মধ্যে বাস করেছে সুরমা। দেহ তাকেও পীড়িত করেছে; কিন্তু তার কাজ সহ্য করা : ‘জীবনের প্রথম-যৌবনের আকুল বাসনার পুষ্পগুলি পরার্থপরতার দীপ্ত হোমানলে ভস্ম। করিয়া ফেলিয়া তাহার হৃদয় কি একটুও বলিষ্ঠ হয় নাই? জীবনের মেহ, ভালবাসা, আশা, তৃষ্ণা এতগুলি জিনিস এক নিমেষে পান করিয়া তাহার মৃত্যুঞ্জয় কঠিন প্ৰাণ কি এখনও এত দুৰ্ব্বল ? না, এ প্রাণকে সবল করিতেই হইবে। ’
সে জানে, ‘তাহার জীবনের সমস্তটা একটা খরচেরই তালিকা-তাহার জমার ঘর একেবারে খালি। ’ তার স্বামীও তাকে মনে করে আত্মোৎসর্গিত দেবী : ‘আমরা ভাবিত, চারু–চারু–চারুই তাহার স্ত্রী… সুরমার কাহারও সহিত বিবাহ হয় নাই, হইতে পারে না, কেন না পৃথিবীর কেহ কি সে? না। সে দেবী, শুধু স্নেহ দিবার জন্যই সে সংসারের সহিত আবদ্ধ। ’ কিন্তু তার চোখে অমরনাথ সপত্নীপ্ৰণয়ে অবিচারক স্বামী’! আমন্বনাথ এক সময় প্রলুব্ধ বোধ করে সুরমার প্রতি, সুরমা তা প্রত্যাখ্যান করে; কেননা বলা কি যাইত না, ‘আজ তুমি আমায় যাহা দিতে আসিয়াছ, তাহা ইতিপূৰ্ব্বে কোথায় ছিল?
আমার নবীন বাসনাময় তরুণ-যৌবনের প্রথম আগ্রহ যে অন্ধের মত চাহিয়া দেখে নাই বা দেখিতে ইচ্ছা করে নাই, সেই তুমি! সেই অবিচারক তুমি!… যাহা আমার নিকট হইতে কাড়িয়া লইয়া অন্যের চরণতলে উপহার দিয়াছিলে, তাহাই আবার আজ আমায় দিতে চাও?’ স্বামীর সাথে বাঙালি নারীর সম্পর্ক যে পারস্পরিক প্রতিপক্ষের, তা সুরমা ও বোধ করে : ‘তাঁহাকে সুরমার এখন তাহার জীবনের সুখস্বৰ্গ হইতে ভ্ৰষ্টকারী দূরদৃষ্ট বলিয়া জীবনের সর্ব জ্বালাযন্ত্রণার মূলীভূত রুষ্ট কুগ্ৰহ বলিয়া, জন্মের সুখদুঃখের নিয়ন্তী, জন্মকেন্দ্ৰস্থিত দুষ্ট নক্ষত্ৰ বলিয়া মনে করিত। ’ বাঙালি নারীর চোখে দেবতা হয়ে ওঠে। দুষ্ট নক্ষত্র, একে যুগান্তর বলা যায়।
কিন্তু এ-সুরমাকে অবশেষে নিরুপমা বিন্যস্ত করেন। পুরুষতন্ত্রের ছকে; চাপিয়ে দেয়া দেবীর ভূমিকা পালন ক’রে যে ক্লান্ত, যার জীবনে পুরুষের প্রয়োজন প্রায় কেটে গেছে, নিরুপমা বিশ্বাসঘাতকতা করেন তার সাথে, উদ্যোগ নেন তাকে অনিচ্ছায়-মেনে-নেয়া দেবীর আসন থেকে দাসীর আসনে বসানোর। তবে তিনি দাসীর গ্লানিকে অস্বীকার করেন নি : ‘একদিন একস্থানে একজনকে সে না’ বলিয়া গিয়াছিল, সেইস্থানে সেই ব্যক্তিকে আর একবার বলিতে হইবে ‘হ্যা’। বলিতে হইবে, নারী-জনের দোষ, ভাগ্যের দোষ, সৰ্ব্বোপরি বিধাতার দোষ। বলিতে হইবে ‘হে দেব, তোমারই জয় হইয়াছেঃ আর কেন–সৰ্ব্বস্ব আহুতি দিয়াছি, সব পুড়িয়া গিয়াছে, এখন এ হোমাগ্নি নিভাও। ’
প্ৰণাম করিয়া বলিতে হইবে, ‘ভস্ম তিলক ললাটে প্রসাদচিহ্ন-স্বরূপ নিৰ্ম্মাল্য-স্বরূপ দাও। তুমি তৃপ্ত হইয়াছ, এখন আমায় মুক্তি দাও। ’ নারীজন্মের অপমান ও যন্ত্রণাকে নিরুপমা অস্বীকার করেন নি, তবে মেনে নিয়েছেন; তিনি যেনো জানেন জয় নারীর জন্যে নয় : ‘তাহার পরাজয় যেন তাহারা দিব্যচক্ষে দেখিয়াই বসিয়া আছে। এমনি নারী-জন্ম লইয়া সে আসিয়াছে! ধিক!’ সুরমা নিজের জীবন সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর উপন্যাসের শেষে বিসর্জন দেয় তার অস্তিত্বকেও বলে, ‘নারীর দৰ্প তেজ অভিমান কিছু নেই.. কেবল ভালবাসা, কেবল দাসীত্ব…। ’
নিরুপমা সুরমাকে অবশেষে বসিয়েছেন পুরুষতন্ত্রের পদতলে; ‘সুরমা সহসা নতজানু হইয়া স্বামীর পাদমূলে বসিয়া পড়িল। দুই হস্তে অমরের পদযুগল জড়াইয়া ধরিয়া অজস্রবাষ্পবারিসিক্ত মুখ উৰ্দ্ধে তুলিয়া বলিল, ‘কেবল–এইটুকু, আর কিছু নয়। আমায় কোথায় যেতে বল? আমার স্থান কোথায়? আমি যাব না। ’ নিরুপমা তার অপচয়িত দেবীকে পরিণত করেন। অসহায় দাসীতে, জানিয়ে দেন যে নারীর মুক্তি নেই; নারীকে বন্দী থাকতেই হবে ছকে ও যন্ত্রণায়। নিজের লিঙ্গের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার এটা এক স্মরণীয় উদাহরণ।
নিরুপমা শ্যামলীতে (১৯১৮) নিয়েছেন শ্যামলী নামের এক ‘কালা বোবা পাগলী’কে, কাব্যিক নামটি ছাড়া আর সবই যার শোচনীয়। তার নায়িকা যে কালা বোবা পাশলী, এটা তাৎপর্যপূর্ণ। নিরুপমা হয়তো এমন একটি নায়িকা বেছে নিয়েছিলেন চরম ভাবাবেগ উৎপাদনের জন্যে, কিন্তু এটাকে আমার মনে হয় অত্যন্ত তাৎপৰ্যপূর্ণ নারীমাত্রই, পুরুষতন্ত্রের কাছে, কালা বোবা পাগলী; তারা যতোই শুনতে বলতে চিন্তা করতে পারুক। পুরুষতন্ত্র সব নারীকেই কালা বোবা পাগলী ক’রে রেখেছে। শ্যামলী কালা বোবা পাগলী, তবে তাকে কেন্দ্ৰ ক’রেই আবর্তিত হয়েছে সব কিছু।
শ্যামলী নারীর চরম দুৰ্দশার রূপ, তবে নিরুপমা তাকে দিয়েছেন এমন একটি স্বামী, যে তাকে মানুষের জীবন দিয়েছে। পুরুষের ওপর দিয়েছেন তিনি কালা বোবা পাগলীকে অর্থাৎ নারীকে মানুষ ক’রে তোলার ভার। এ-কাহিনী বাস্তবের নয়, ইচ্ছাপূরণের; সব নারীই যদি পেতো এমন পুরুষ, তাহলে তাদের জীবন মানুষের জীবন হয়ে উঠতো। শ্যামলী নারী, তার জীবন নিৰ্ম্মফল হওয়ার জন্যে এ-ই যথেষ্ট, তার ওপর সে কালা বোবা পাগলী: অন্যরা ও নিরুপমা তাকে বার বার জন্তু’, ‘জানোয়ার’ ব’লেই নির্দেশ করেছেন। সমস্ত নারীর মতো বিয়েই তার প্রধান সংকট। তার বিয়ের কোনো সম্ভাবনা ছিলো না; কিন্তু তার পিতার এক উন্মত্ততায় তার বিয়ে হয়ে যায় তারই ছোটোবোনোর বর অনিলের সাথে।
শ্যামলী নিজের জন্যে যতোটা সমস্যা, তার চেয়ে বড়ো সমস্যা পিতার জন্যে : ‘কিন্তু কালা বোবা এবং পাগল এই ত্রিবিশেষণ-বিশিষ্টা কন্যাকে নামে মাত্র সম্প্রদানের জন্য ও স্বজাতি এবং সমকুলস্থ এমন কোন পাত্রই তিনি তখন খুজিয়া পাইলেন না যে তাঁহাকে জাতিচ্যুতি হইতে রক্ষা করে। ’ তাই পিতা এক অদ্ভুত উন্মাদের কাজ করে, তার ভাষায়, ‘আমি সমাজের এই অত্যাচার থেকে বাঁচবার জন্যই এই অভাগা জীবটাকে একবার গোটাকতক মন্ত্র পড়িয়ে বিজলীর বিয়ের আগে সম্প্রদান করে নিলাম মাত্ৰ। ’ শ্যামলী তার বাবার চোখেও ‘একটি জানোয়ার মাত্র। ’
নিজেকে বাঁচানোর জন্যে সে মন্ত্ৰ পড়িয়ে নেয়, ৩বে মেয়েকে বাঁচানোর কোনো আগ্রহ তার নেই; সে অনিলকে বলে, ‘এখন এ ঘটনা তুমি মন থেকে শীগগিরই মুছে ফেলো, ভাল মেয়ে দেখে বিয়ে কোরো–সুখী হয়ো, এই আমার তোমায় আন্তরিক আশীৰ্ব্বাদ। অনিল আদর্শবাদী পুরুষ; সে শ্যামলীর ছোটো বোন বিজলীকে আর বিয়ে করতে রাজি হয় নি, বরং তখনি বিজলীর বিয়ের ব্যবস্থা করেছে বন্ধু শিশিরের সাথে। এরপর নিরুপমা দীর্ঘ কাহিনী ব’লে একটি আদর্শবাদী স্বামীকে দিয়ে শ্যামলীকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন জীবনে। নিরুপমা নারীকে প্রথাগত ছক অনুসারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সাথে সাথে প্রকাশ করেছেন নারীর বেদনা। অনিল তাকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসার পর শ্যামলীর অব্যক্ত আর্তনাদে প্ৰকাশ পায় সব নারীর যন্ত্রণা : ‘মাগোকোথায় তুমি! এ আমি কোথায় আসিলাম মা?… এখানে যে আমি আর একদণ্ডও বঁচিতে পারিতেছি না। ’ পৃথিবীতে পা দিয়ে প্রতিটি নারীই এমনভাবে চিৎকার ক’রে উঠতে পারে।
শ্যামলীর ভাগ্য ভালো সে অনিলের মতো দেবতার পায়ে পড়েছে। অনিল আর বিয়ে করতে রাজি হয় নি, এটা তার মহত্ত্ব; তবে শ্যামলীর কি রয়েছে আবার বিয়ের অধিকার? আনিলের মনে নিরুপমা যে-প্রশ্ন জাগিয়ে দিয়েছেন, সেটি আসলে নারীর প্রশ্ন : ‘সমাজ পুরুষের দ্বিতীয়বার বিবাহ স্বচ্ছন্দে অনুমোদন করিবে। আর স্ত্রীলোকের পক্ষে তাহা খাটিবে না, সেই জন্যই কি এ ব্যবস্থা? এই অৰ্দ্ধমনুষ্য প্রাণীটির পক্ষেও কি এই নিয়ম! অনিলের যদি এ বিবাহ অসিদ্ধ হয়, তাহারই বা কেন না হইবে? তাহাকে আর কেহ বিবাহও করিবে না এবং যাহার সহিত বিবাহ হইল তাহারও গ্রহণযোগ্য সে হইবে না?
তবু অনিলকে মনে মনে স্বামী বলিয়া তাহাকে চিরদিন জানিতে হইবে। তাহার বিবাহের সম্ভাবনা না থাকিলেও অন্য ভয়ের সম্ভাবনা যথেষ্ট আছে, সেইজন্যই তাহার জানিতে হইবে তাহার বিবাহ হইয়াছে, তাহার স্বামী আছে, অমুক তাহার স্বামী!’ অনিলের বন্ধু ব্যক্তি করেছে। পুরুষতন্ত্রের সিদ্ধান্ত : ‘তুমিও জান এবং আমিও জানি যে স্ত্রীপুরুষের এ সাম্যবাদের নীতি বহু দেশে বহু তর্কের সঙ্গে চললেও সমত্ব কখনই মানুষে তাদের দিতে পারবে না। কিসে পারবে-প্রকৃতিই যে তাদের দুৰ্ব্বল করে রেখেছে। …
হাজার শিক্ষা দাও, সুবিধা দাও, স্বাধীনতা দাও, ভগবান তাদের নীড় বাঁধবার জন্যেই তৈরী করেছেন; তৰ্ক মীমাংসা শুতি স্মৃতি ঘটিবার জন্যে বা যুদ্ধ করুবার জন্যে নয়।. সাধারণতঃ নারীদের ভগবান স্নেহদুৰ্ব্বল স্বভাবীদুৰ্ব্বল করে যে সৃষ্টি করেছেন।. গৃহের মেরুদণ্ড স্বরূপেই ভগবান স্ত্রীজাতিকে সৃষ্টি করেছেন। তাঁরা শিক্ষাদীক্ষা বা অন্যান্য সব অধিকারে পুরুষের তুল্য হোন ক্ষতি নেই, কিন্তু তাঁরা এই গৃহকে না অতিক্রম করেন, তাদের নারীত্ব না ভুলে যান! তা হলেই ধৰ্ম্মনাশ হবে!’ নিরুপমা প্রথাগত, তবে তিনিও পুরুষতান্ত্রিক এ-বক্তৃতায় বিশ্বাস করেন না।
অনিল আদর্শবাদী হ’লেও নিরুপমা একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটিয়েই শুধু অনিলকে দিয়ে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করিয়েছেন শ্যামলীকে। অনিলকে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত ক’রে কুৎসিত পুরুষে রূপান্তরিত করেন। যখন সে সুদর্শন ছিলো, যোগ্য ছিলো যে-কোনো রূপসী তরুণীর স্বামী হওয়ার, তখন সে তার আদর্শবাদ সত্ত্বেও নিদ্বিধায় শ্যামলীকে স্ত্রী হিশেবে গ্রহণ করতে পারে নি, পেরেছে বসন্তে বিকৃত হয়ে যাওয়ার পর। একটি বিকৃত কুদৰ্শন পুরুষ একটি ‘অৰ্দ্ধমনুষ্য’, ‘অসম্পূর্ণ জীবকে স্ত্রী হিশেবে নিতে পারে, এটা সমাজের কাছে স্বস্তিকর; একটি যোগ্য পুরুষ গ্ৰহণ করবে একটি অযোগ্য নারীকে, এটা স্বস্তিকর নয়।
সে জন্তুর সমতুল্য হ’লেও মাঝে মাঝে দেখা যায় তার ‘কেমন এক রকম দৃষ্টি,–মুখের ও সারা অঙ্গের বিদ্রোহসূচক ভাব!’ অনিল তাকে মুক-বধিরদের শেখানোর রীতিতে শিক্ষা দিতে থাকে, জাগিয়ে তুলতে থাকে তার প্রকৃত নারীত্ব’। তার নারীত্ব জেগে ওঠে ঈর্ষার মধ্য দিয়ে : ‘এই অৰ্দ্ধমনুষ্য জীবটি, যাহাকে এতদিন উন্মাদ জড় বলিয়াই সকলে জানিত, অনিলও যাহাকে এতদিন পূর্ণ নারী বলিয়া অনুভব করিতে পারে নাই, যাহার বুদ্ধি স্নেহ ভালবাসা রাগ বা দুঃখ সমস্ত একেবারে এতদিন বালকের মতই ছিল, সেই শ্যামলীতে নারীত্ত্বের এই নিকৃষ্ট অংশটি সহসা এমনই ভাবে কি ফুটিতে পারে? সে হিংসা করিতেছে?’ নিরুপমা প্রশ্ন করেছেন : ‘এই ঈর্ষা, নারীত্বের এই রহস্য, এ যে বিধাতারই নিজহস্তে দত্ত নারী-জীবনের অভিশাপ!— ইহা হইতে কোন নারী মুক্ত?’
বিধাতা! যে-শ্যামলীকে জন্তু হিশেবে সৃষ্টি করেছিলো, অনিল, এক পুরুষ, তাকে পুনরায় সৃষ্টি করে মানবী ও দেবীরূপে : ‘সেই জড়বুদ্ধিসম্পন্ন অৰ্দ্ধোন্মাদ শ্যামলীতে প্রথমে মানবীত্ব আনিয়া পরে ক্রমশঃ তাহতে আজিকার এই দিবীত্বের ক্ষুদ্রণ ইহাও আনিলের জীবন-ঢালা ব্ৰতেরই ফল বলিয়া রেবার মনে হইল।’ শ্যামলীতে একটি জন্তুকে উন্নীত করা হয়েছে ছকবাধা নারীর স্তরে, এতে ভূমিকা পালন করেছে একটি পুরুষ: পুরুষই হয়ে উঠেছে নারীর স্রষ্টা।
শান্তা দেবীর জীবনপোলা (১৯৩৮) সচেতনভাবে লেখা হয়েছে নারীমুক্তির বাণী প্রচারের জন্যে, তবে তিনি বিধবার বিয়ের অধিকারকেই গণ্য করেছেন মুক্তি ব’লে। উপন্যাসটি আট বছর বয়সে বিবাহিত বালবিধবা গৌরীর উপাখ্যান। দু-খণ্ডে তিনি কাহিনী বলেছেন : প্রথম খণ্ডে দিয়েছেন বালিকা গীেরীর বিধবাজীবনের দুর্দশার বিবরণ, এবং দ্বিতীয় খণ্ডে বর্ণনা করেছেন ওই জীবন থেকে মুক্তির কাহিনী। প্রথম খণ্ডটির কোনো কোনো অংশ মর্মস্পশী, তবে দ্বিতীয় খণ্ডে তিনি গীেরীকে মুক্ত করার জন্যে যে-কাহিনী তৈরি করেছেন, তা আবেদন জাগায় না।
রচনা হিশেবে আলোচিত ছটি উপন্যাসের মধ্যে জীবনদোলাই সবচেয়ে দুর্বল। শান্তা দেবী জীবন উপস্থাপনের থেকে প্রচারে বেশি মন দিয়েছেন বলে লক্ষ্য অর্জনেও তিনি সফল হন নি; তবে তাঁর কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি নারীকে মুক্ত করে ছক থেকে বের করে আনতে চেয়েছেন। শুরু থেকেই তিনি বিয়ে ও পুরুষবিরোধী মনোভাব প্রচার করেছেন; তাঁর অবোধ বালিকা গৌরী বলে, ‘ছাই বর! আমাকে মার কাছ থেকে আবার নিয়ে যাবে!… আমি ধুতি পারব, চুল কেটে ফেলব; মেয়েমানুষ হব না। আমি ঘরে-ঘরে বিয়ে করুব। ’ গৌরী যেনো প্রতিশোধ নিতে চায় পুরুষের ওপর।
বিয়ের পর গীেরী একবার শ্বশুর বাড়ি গিয়েছিলো : ‘একরাত্রি নয় আট রাত্রি এই অজানা পুরীতে ভয়ে শোকে দুঃখে অনিদ্রায় অৰ্দ্ধানিদ্রায় মাতৃক্রোড়চূতা গৌরীর প্রাণ কাদিয়াছিল, ফেরার পর দু-বছরেও তার মন হইতে শ্বশুরবাড়ীর সে বিভীষিকার ছবি মোছে নি। গৌরীর ভাগ্য সে বাড়ীর বড় আদরের মেয়ে। তার বাবা ‘আট বছরের মেয়েটাকে দান করে পুণ্য সঞ্চয়’ করতে গিয়েছিলো; তার জন্যে যা পুণ্য গৌরীর জন্যে তা হয়ে ওঠে বিনাশ। তার শ্বশুরবাড়ি খবর যায় যে ‘বিধবা মেয়েকে হরিকেশব সধবা বেশে ত রাখিয়াছেনই। তাহার বৈধব্যের খবর পর্য্যন্ত তাহাকে জানিতে দেন নাই। ’
এটা গৌরীর শ্বশুরবাড়িতে উত্তেজনা সৃষ্টি করে; এক আশ্ৰিতা বিধবা ব’লেই বসে, ‘তোমার বেয়াই মেয়েকে কলমা পড়াবে, নিকে দেবে। ’ নারীর বিরুদ্ধে নারীও কাজ করতে পারে নিপুণ ও নিষ্ঠুরভাবে। গৌরীর বাবা পুরুষ, তবে মানুষ; তাই মেয়ের জীবনকে কিছুটা স্বস্তিকর করে তোলার জন্যে তিনি মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তীর্থভ্রমণে। তার বাবা জানে, ‘তারা পুত্ররা যে পুরুষ। সংসারে তারা লড়তে জন্মেছে, সংসার তাদের লড়বার অধিকারও দিয়েছে। আর এ অসহায় শিশু বালিকা; মেয়ে হ’য়ে জন্মানোই এদেশে তার এক পরম দুৰ্ভাগ্য, তার উপর নূতন একটা দুর্ভাগ্যের বোঝা আজীবনের জন্য তার কচি মাথার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ’ গৌরী অবশ্য জানে না। সে বিধবা, সে বোঝে না বিধবা কাকে বলে: তবে পিতৃতন্ত্র তাকে এর মাঝেই বিধবার শাস্তি দেয়ার জন্যে ব্যগ্র হয়ে পড়েছে।
শান্তা দেবী গৌরীর বাবামার মনে প্রশ্ন জাগিয়ে দিয়েছেন : ‘সেই তরুণ শৈশবের দেখা অপরিচিতপ্রায় একটি বালকের তিরোধানে তাহার জীবনমুকুল সমাজের চক্ষে চির-অভিশপ্ত হইয়া গিয়াছে?.. কিন্তু অচেনা মানুষের অজানা মৃত্যুতে শিশুকেও যে চির-সন্ন্যাসের বোঝা বহিয়া অপমান ও লাঞ্ছনায় আজীবন কৃত্রিম শোকের অভিনয় করিয়া যাইতে হয়, তাহাকেই ধৰ্ম্ম বলিয়া মানিতে হয়, সে-কথা তাহার এই আদরিণী অভিমানিনী বালিকা কন্যাকে তিনি কি করিয়া বুঝাইবেন?’
গৌরী যখন জানতে পায় যে সে বিধবা, তখন তার অবস্থা : ‘বাঙ্গালীর মেয়ে সে আপনার বঞ্চিত জীবনের কথা যতটুকু বুঝিল তাহাতেই নিরানন্দের স্নান ছায়ায় তাহার ফুলের মত মুখখানি অন্ধকার হইয়া গেল। অজানা সেই মানুষের মৃত্যু তাহার কাছে যতই অর্থহীন হোক পৃথিবীর কাছে তাহার বহু অধিকার যে সেই মানুষটিই হরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে হিন্দুর মেয়ের মনে সেকথা ধরা পড়িলই। ’ শান্তা দেবী চিরস্বামীত্বের ধারণাটিকে স্পষ্টভাবেই বাদ দিয়েছেন। এমনকি গৌরীর প্রথাগত মায়ের মনেও হিন্দুবিবাহের বিধান সম্পর্কে সন্দেহ জাগিয়ে তুলেছেন : ‘তরঙ্গিনীর স্বামীর কথা মনে পড়িল, ‘আবাবা যদি ওর বিয়ে হয়। ’
এমন পাপ কথা মনে আনিতে তাঁহার যতখানি ঘৃণা যতখানি লজ্জা হওয়া উচিত ছিল, তিনি আশ্চৰ্য্য হইয়া দেখিলেন কই সে লজ্জা, সে ঘূণা ত তাহার মনে আসিল না। শান্তা দেবী পুত্র ও কন্যার জীবনের দুই মেরুরূপের চিত্রও এঁকেছেন : ‘এই ত্যাণ সমাজ তাহার নিকট জোর করিয়া আজীবন নিষ্ঠুর মহাজনের মত আদায় করিবে; তাহার পাঁচ ভাই যখন পিতার ঐশ্বৰ্য্যে ভোগ বিলাসে মাতিয়া থাকিবে তখন এই সকলের ছোট বোনটি বঞ্চিত জীবনের বোঝা বহিয়া বিস্মৃত স্বামীর প্রতি প্রেম ও ভক্তি নিবেদন করিবে।
গৌরী বোঝে না যে সে বিধবা, কিন্তু তার মুখে শান্তা এমন কথা দিয়েছেন, যেমন, ‘আমার মেয়েকে আমি কখখনো বিয়ে দেব না। বাবা, শেষকালে যদি বিধবা হ’য়ে যায়৷’ বা ‘বিধবা হাতে আমার ভাল লাগে না। কেন মা, আমি বাইরের লোকের জন্যে বিধবা হব?’, যা তুলে ধরেছে পিত্তান্ত্রিক বিধানের নিষ্ঠুরতা। শান্তা গৌরীকে আত্মোৎসৰ্গিত বিধবার ছকের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তার মনে জাগিয়ে দিয়েছেন মুক্তির অভিলাষ : ‘গৌরী ঠিক করিল এমন করিয়া পুতুলের মত দিন সে কাটিতে দিবে না। যেমন করিয়াই হউক একটা পথ তাহাকে করিতে হইবে। তাহাকে মুক্ত হইতে হইবে। ’
দ্বিতীয় বা মুক্তিখণ্ডে শান্তা প্রচুর পরিশ্রম করেছেন গৌরীর মুক্তির গল্প বানাতে : তৈরি করেছেন তিনটি স্বদেশী যুবক, প্রতিষ্ঠা করেছেন হৈমবতীর কন্যাশ্রম, সেখানে বহু দুর্গত তরুণীর সাথে রেখেছেন গৌরীকে, এবং তরুণতরুণীদের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন প্রেমাবেগ। নারীকে মুক্ত করার জন্যে পরিশেষে দিয়েছেন দুটি প্লটবাঁধা যুগ্ম বিয়ে : বিধবা গৌরীকে বিয়ে দিয়েছেন সঞ্জয়ের সাথে, আর সঞ্জয়ের পিতার অবৈধ কন্যা চঞ্চলাকে বিয়ে দিয়েছেন গৌরীর ভাই শঙ্করের সাথে। ভাইয়েরা উদ্ধার করেছে। পরস্পরের বোনদের। তিনি ছক ভেঙেছেন, নতুন ভাবমূর্তি সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন; কিন্তু ব্যৰ্থ হয়েছেন উপন্যাস লিখতে এবং নারীর সপক্ষে গভীর আবেদন সৃষ্টি করতে।