[প্রথম খন্ড]
উপন্যাসের উদ্ভব ঘটেছিলো নানা উদ্দেশ্যে; তার একটি নারীদের নীতিশিক্ষা দেয়া, অর্থাৎ শুরু থেকেই উপন্যাসের বিশেষ লক্ষ্যবস্তু নারীরা। পশ্চিমের পুঁজিবাদী পুরুষেরা চেয়েছিলো নারী উপন্যাস উপভোগ ও উপন্যাসের ফল ভোগ করবে, সতী হবে, এবং রমণীর গুণে সুখে ভ’রে উঠবে সংসার। তখন তারা ভাবে নি ওই নারীও উপন্যাস লিখবে একদিন, শোনাবে নিজের মর্মান্তিক পুরুষপীড়িত জীবনকাহিনী। পুরুষ নারীর সৃষ্টিশীলতায় বিশ্বাস করে নি কখনো, আজো সন্দেহের চোখে দেখে নারীর সমস্ত সৃষ্টিকে; সাধারণত তাকে স্বীকৃতি দেয় না, বা দেয় নিজেরই স্বার্থে।
বাঙলা ভাষায় প্রথম উপন্যাস লেখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন এক বিদেশিনী, হেনা ক্যাথেরিন মুলেন্স, যিনি ফুলমণি ও করুণার বিবরণ (১৮৫২) নামের একটি উপন্যাস-খসড়ায় নারীদের দিতে চেয়েছিলেন খ্রিষ্টীয় করুণার শিক্ষা, পুরুষের ছক অনুসার ঢালাই করতে চেয়েছিলেন নারীদের। বাঙালি নারীরা যখন প্রথম উপন্যাস লেখা শুরু করে, তখন পুরুষ এ-কাজকে অনাচার বলেই গণ্য করে; আজো বাঙালি পুরুষ তাদের সম্পূর্ণরূপে স্বীকার ক’রে নেয় নি। তবে বাঙালি নারী উপন্যাসে হাত দিতে দেরি করে নি; পুরুষের প্রথম উদ্যোগের দু-দশকের মধ্যেই বেরোয় নারীর প্রথম উপন্যাস : স্বর্ণকুমারী দেবীর দীপনির্বাণ (১৮৭৬)। তার অন্য কয়েকটি উপন্যাস ছিন্ন মুকুল (১৮৭৬), বিদ্রোহ (১৮৯০), স্নেহলতা (১৮৯২), ফুলের মালা (১৮৯৪), হুগলীর ইমামবাড়ী (১৮৯৪), কাহাকে (১৮৯৮)।
অল্প পরেই দেখা দেন জনপ্রিয় অনুরূপা দেবী ও নিরুপমা দেবী, তাঁরা দুজনে লেখেন প্রচুর উপন্যাস। নিরুপমার উপন্যাস অন্নপূর্ণার মন্দির, দিদি (১৯১৫). বিধিলিপি (১৯১৭), শ্যামলী (১৯১৮); অনুরূপার উপন্যাস মন্ত্রশক্তি (১৯১৫), মহানিশা (১৯১৯), মা (১৯২০), গরিবের মেয়ে, পথহারা, ত্রিবেণী (১৯২৮), জ্যোতিঃহারা, চক্র; এবং দেখা দেন প্ৰভাবতী দেবী সরস্বতী, শৈলবালা ঘোষজায়া, সীতা দেবী, শান্তা দেবী, ও আরো অনেকে। ভার্জিনিয়া উলফ বলেছিলেন যে উপন্যাস নারীর একান্ত শিল্পাঙ্গিক, বাঙালি নারীরা তার কথাকে অনেকখানি সত্যে পরিণত করেছে।
বাঙালি নারী ঔপন্যাসিকদের উপন্যাস জনপ্রিয় হয়েছিলো, কিন্তু তা পুরুষের কাছে গুরুত্ব পায় নি; বরং উপহাসের সামগ্ৰী হয়েছে। তারা প্রচুর উপন্যাস লিখেছেন, বিক্রিও হয়েছে প্রচুর; তবে তা হয়ে আছে এক উপসংস্কৃতিধারা, যেনো তা নারীদেব জন্যে নারীদের লেখা, পুরুষের মূলধারার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অযোগ্য। বঙ্কিমচন্দ্ৰ নারীদের উপন্যাসকে দেখেছেন আত্মম্ভরী পুংসুলভ করুণা ও উপহাসের চোখে। তিনি বাঙালি নারী ঔপন্যাসিকদের গোণার মধ্যেই ধরেন নি, তখনো তারা দেখা দেন নি বলেই শুধু নয়, দেখা দিলেও পুঁছতেন না তিনি তাঁদের; তিনি পশ্চিমের প্রধান নারী ঔপন্যাসিকদেরও করুণা করেছেন। কমলাকান্তের দপ্তর-এ (১৮৭৫) ‘মনুষ্য ফল’ রচনায় কমলাকান্তের মুখে বঙ্কিমচন্দ্ৰ বলেছেন :
তার পরে মালা–এটি স্ত্রীলোকের বিদ্যা–কখন আধখানা বৈ পূরা দেখিতে পাইলাম না। নারিকেলের মালা বড় কাজে লাগে না; স্ত্রীলোকের বিদ্যাও বড় নয়। মেরি সমরবিল বিজ্ঞান লিখিয়াছেন, জেন অষ্টেন বা জর্জ এলিয়ট উপন্যাস লিখিয়াছেন-মন্দ হয় নাই, কিন্তু দুই মালার মাপে।
কমলাকান্তের মতকে বঙ্কিমের মত ব’লেই ধরতে পারি, এতে প্ৰকাশ পেয়েছে উগ্র পুংতান্ত্রিক মনোভাব। যে-জর্জ এলিয়টকে ‘মালার মাপের ঔপন্যাসিক’ বলে বাতিল ক’রে দিয়েছেন বঙ্কিম, বাঙলার প্রথম নারী ঔপন্যাসিক স্বর্ণকুমারীর দেবীর কাহাকে (১৮৯৮) উপন্যাসের চরিত্ররা তাকে নিয়ে তর্ক করেছে, তুলনা করেছে শেক্সপিয়রের সাথে। স্বর্ণকুমারী ডাক্তার বিনয়কুমারের মুখে দিয়েছেন তাঁর নিজেরই কথা, যা পুরুষতান্ত্রিকদের কাছে গণ্য হবে ক্ষমার অযোগ্য অবিনয় ব’লে। এটা বুঝিয়ে দেয় নারীরা সব সময়ই সন্দেহ বোধ করেছে পুরুষের মূল্যায়ন সম্বন্ধে; তারা নিজেরাও মূল্যায়ন করেছে সব কিছু, যদিও তা প্ৰকাশ করার সুযোগ ও সাহস পায় নি।
সুযোগ পেলেই তারা ভিন্ন মত প্ৰকাশ করতে দ্বিধা করে নি। স্বর্ণকুমারীর চোখে জর্জ এলিয়ট এক শেক্সপিয়র, তার চোখে বঙ্কিম কী, তা জানা যায় নি; কিন্তু তিনি যদি জর্জ এলিয়ট ও বঙ্কিমের তুলনা করতেন, তাহলে বঙ্কিমকে হয়তো গণ্য করতেন জর্জ এলিয়টের তুলনায় খুবই তুচ্ছ ঔপন্যাসিকরুপে। পুরুষ মেনে নিতে পারে নি নারীর সাহিত্যসাধনাকে, কেননা এটা পুরুষের এলাকা; তাই নারীকে পুরুষ বার বার ফেরত পাঠাতে চেয়েছে ঘরের ভেতরে, সরাসরি রান্নাঘরে। যেমন জগদীশ্বরী দেবীর দ্ৰৌপদী কাব্য সম্পর্কে দীনেশচন্দ্র সেন (১৩১২, ৪০০) বলেছেন :
গ্রন্থকর্ত্রী যদি কাব্যশালা হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়া রন্ধনশালার ভার গ্রহণ করেন, তবে অনেক উপাদেয় সামগ্ৰী প্রস্তুত হইতে পারে–সে স্বাভাবিক পন্থা ছাড়িয়া তিনি ভিন্ন উপায়ে লোকরঞ্জনের প্ৰয়াসী হইয়া মোটেই ভাল করেন নাই।
দীনেশচন্দ্ৰ সাহিত্য সমালোচনায় ব’সে ভুলতে পারেন নি যে কবিটি নারী, তাঁর কাজ রান্না করা। পশ্চিমের পুরুষতান্ত্রিক সমালোকেরা নারীসাহিত্য সমালোচনার নামে সাধারণত মাপেন বইয়ের বক্ষ ও নিতম্ব, সম্ভোগ করেন নারীদের বই; বাঙালি সমালোচকেরা তা পারেন না। সমাজিক কারণে, তাই তারা খাদ্যের মতো আস্বাদন করেন নারীসাহিত্য। স্বামী হিশেবে যেমন তারা পরখ করেন স্ত্রীর রান্না, সমালোচক হিশেবে তেমনি স্বাদ নেন সাহিত্যরান্নার। বাঙালি পুরুষের কাছে নারীসাহিত্য এক ধরনের পাকপ্ৰণালি, যা আসল পাকপ্ৰণালির থেকে নিকৃষ্ট। রান্নাবান্নার থেকে উৎকৃষ্ট, নারীর জন্যে শ্ৰেষ্ঠ, কাজ হচ্ছে স্বামীসেবা; তাই নারীসাহিত্য তখন প্রশংসা পেয়েছে, যখন তা স্বামী ও সংসারসেবার গান গেয়েছে।
ভারতীতে (১৩১৬, ৪৬৮) অজ্ঞাতনাম এক সমালোচক শরৎকুমারীর শুভবিবাহ উপন্যাসটি আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘সাহিত্য-সেবারতা, নিষ্ঠাবতী শরৎকুমারীর পতিভক্তি ও সংসারপালনদক্ষতা প্রভৃতি প্রকৃতই অনুকরণীয়। ’ তাঁর সাহিত্যের মূল্য নেই, মূল্যবান তাঁর পতিভক্তি ও সংসারপালনদক্ষতা। নারী কিছু লিখেছে, এটাই আপত্তিকর; তার ওপর যদি তাতে থাকে পাণ্ডিত্য, তবে তা হয়ে ওঠে দ্বিগুণ আপত্তিকর। পুরুষের প্রিয় হচ্ছে মূর্খ নির্বোধ নারী, পুরুষের কাছে প্ৰিয় নারীর শান্ত সরলতা; নারী যখন শান্ত সরলতার সীমা পেরিয়ে যায়, তখন সহ্য করা অসম্ভব হয়ে ওঠে পুরুষের পক্ষে।
শরৎচন্দ্ৰ, যিনি নারীর পক্ষে লিখেছিলেন নারীর মূল্য (১৩২০), তিনিও নারীর পাণ্ডিত্যের ঝাঁঝ সহ্য করতে পারেন নি। অনিলা দেবী ছদ্মনামে শরৎচন্দ্ৰ লেখেন ‘নারীর লেখা’ (১৩১৯) নামে একটি নারীসাহিত্যবিদ্বেষী প্ৰবন্ধ। নারীনামের ছদ্মবেশে লুকিয়ে নারীকে আক্রমণ করা পুরুষের এক প্রিয় হীন স্বভাব। এতে তিনি উপহাস করেন নারী লেখকদের–আমোদিনী ঘোষজায়া, অনরূপ দেবী ও নিরুপমা দেবীকে; পরিহাস করেন তাদের পাণ্ডিত্যকে, উপহাস করেন তাদের অভিজ্ঞতার অভাবকে; ধরেন তাদের নানা রকমের ভুল, এবং উড়িয়ে দেন নারীসাহিত্যকে, যেনো সাহিত্যচর্চা নারীদের জন্যে অনধিকারচর্চা।
কুমুদিনীমোহন নিয়োগী (১৩২৯, ৬৮৫) এক লেখিকাকে প্রশংসা ক’রে লিখেছেন : ‘তাঁর রচনার একটি প্রধান বিশেষত্ব–সরলতা আর শান্ত সংযত ভাব। অনেক নারীর রচনায় দেখি, পাণ্ডিত্যের ঝাঁঝ এমনি তীব্ৰ হল্কা ফুটাইয়া রহিয়াছে যে গা একেবারে জ্বলিয়া যায়। এই ঝাঁঝ ইন্দিরা দেবীর রচনায় মোটেই নাই। ’ ঝাঁঝ সৃষ্টির অধিকার শুধু পুরুষের; নারী ঝাঁঝ সৃষ্টি করবে না, এমন কিছু করবে না যা পুরুষের অহমিকাকে পীড়িত করতে পারে। নারী যদি সাহিত্য সৃষ্টি করতেই চায়, তাহলে সে এমনভাবে করবে, যা উপাদেয় হবে পুরুষের রসনায়।
প্রভুর দর্শনে দীক্ষিত হয় অসংখ্য দাসদাসী, অসংখ্য নারী ও দীক্ষিত হয়। পুরুষের মন্ত্রে; আজো অনেক নারী গলগল ক’রে উচ্চারণ করে প্রভুপুরুষের মন্ত্র। যেমন, নগেন্দ্ৰবালা সরস্বতী নারীধৰ্ম্ম কাব্যের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘সংসারে রমণীগণ প্ৰেমগ্ৰীতির আকরম্বরূপ। তাহাদেরই স্নেহ-মমতা-পবিত্রতায় সংসার শান্তিময়, এই জন্যই হিন্দু সংসারে রমণীগণ দেবীবৎপূজনীয়া। কিরূপে রমণীগণ নিজ নিজ কৰ্ত্তব্য পালন পূর্বক নারীধৰ্ম্ম রক্ষা করিয়া–সংসারে অমৃত স্রোত প্রবাহিত করিতে পারেন, কিরূপে নারীচরিত্রে প্রকৃত দেবীচরিত্র প্রতিভাত হইতে পারে, এই নারীধৰ্ম্মে তাহারই আলোচনা করিয়াছি। ’ এতে খুব প্রীত হওয়ার কথা পুরুষের, যেমন হয়েছেন চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় (১৩১০, ১৯৯)। তিনি নারীধৰ্ম্ম এর প্রশংসা করেছেন এভাবে :
মোটের উপর এগ্রন্থ পাঠে আমরা বড় প্রীত হইয়াছি-প্রীত হইবার আর একটি বিশেষ কারণ এই যে, শ্ৰীমতী নগেন্দ্ৰবালা এতদিন কবিতায় আলোচনা কবিয়া যশঃসঞ্চয়ে ব্ৰতিনী ছিলেন–এখন তিনি সংসারধর্মের সংস্কারে মন দিয়াছেন; নিরবচ্ছিন্ন কবিতা রচনাই যে রমণীজীবনের চরম লক্ষ্য নহে, এবং তাঁহাতে যে রমণীর তৃপ্তি হয় না, ইহা তিনি বুঝিয়াছেন।
কবিতা লিখতে গিয়ে নগেন্দ্ৰবালা যে ভুল ও অপরাধ করেছিলেন, তা বুঝতে পেরে তিনি যে আবার মন দিয়েছেন। ‘রমণীজীবনের চরম লক্ষ্য’ সংসারধর্মে, এতে সমগ্র পুরুষসমাজেরই প্রীত বোধ করার কথা। নারীর সাহিত্যচর্চা পুরুষের চোখে বিকার, নারীর বিখ্যাত হওয়ার বাসনা অমার্জনীয় অপরাধ; তবু নারী সাহিত্য সৃষ্টি করেছে। এ-অপরাধের শাস্তি নারীর প্রাপ্য; পুরুষ তাকে শাস্তি দিয়েছে তার সাহিত্যকে অস্বীকার ক’রে।
পুরুষসমাজের এ-স্বভাব, এবং তাদের মন্ত্রে দীক্ষিত সংসারধর্মী অজস্র নারীর নারীপ্রতিভাবিরোধিতা বুঝতে পেরেছিলেন ভারতীর ‘বঙ্গনারী’ (১৩৩৯, ৬৩৭)। তিনি ‘স্ত্রীলেখিকা’ নামের এক রচনায় লিখেছিলেন :
মাসিক পত্রের পৃষ্ঠা উল্টাইতে উল্টাইতে তাহার যে নমুনা পাওয়া যায়, তাহাতে আমাদের দেশে লিখিতে সমর্থ –সুতরাং ‘শিক্ষিতা’দের মধ্যেও Mrs. Grundyর প্রাদুর্ভাব দেখিয়া দমিয়া যাইতে হয়। ইহা অবশ্য আশ্চর্য্যের কথা নহে,–সকল দেশেই ইহাদের দর্শন পাওয়া যায়; এবং সৰ্ব্বত্রই ইহারা করতালি পাইয়া থাকেন। তবে মেয়েদের উঠিতে হইলে ঘরে বাহিরে কি পরিমান বাঁধা অতিক্ৰম করিতে হইবে, ইহারা কেবল তাঁহাই মনে করাইয়া দেন; মেয়েদের বিষয় যে রকম অসঙ্কোচে হীনভাবে ইহারা বলিতে পারেন, পুরুষের পক্ষে অবশ্য তাহা সম্ভব নয়।
আর সর্ব্বত্রই ইহাদের বদ্ধ ও স্কুল দৃষ্টি এবং মনের পরিধির সঙ্কীর্ণতা পীড়া দেয়। ‘দাস মনোভাব’ যে ইহাদের কতটা মজ্জাগত তাহা বলাই বাহুল্য।… বাস্তবিকই, বর্তমান পৃথিবীব্যাপী নারী-জাগরণের দিনে তাহার কোন তরঙ্গই ইহাদের স্পর্শও কবে নাই, বাঙ্গালী ঘরের বদ্ধ একন্ত দূষিত, হীন, খুঁটিনাটি ছাড়াইয়া কল্পনাও একতিল উপরে উঠিতে পারে নাই!… ই্হাদের মধ্যে কাহারও কাহারও মেয়েদের জন্য সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও অপূৰ্ব্ব কিছু করিবার চেষ্টা দেখা যায়।
ইহারা তাহাতেই একটি মৌলিক পথ আবিষ্কার করিয়াছেন বলিয়া মনে করেন। কিন্তু ইহারা ধারণা করিতে পারেন না, –ইহাও তাঁহাদের ‘নারীত্ব’ হইতে প্রাপ্ত অদ্ভুত কোন পদাৰ্থ নয়, অপর পক্ষেরই শিখানো বুলি। তাহারাই ত মেয়েদের ‘পুরুষের মত’ করিয়া কিছু করিতে জোরের সহিত বারণ করিয়া আসিতেছেন। বাস্তবিকই ইহাদেরও মেয়েদের সকল শিক্ষাদীক্ষা গোড়া হইতে মেয়েলি করিয়া ফেলিবার আগ্রহ দেখিয়া দুঃখও হয়। ইহারা অপর পক্ষের চাবটী বেশ গিলিয়াছেন বোঝা যায়। মেয়েরা ইহাদের মতে চলিয়া ‘বুদ্ধিমতী’ না হইয়া ‘প্রাণময়ী’ বনিতে থাকিলে তাঁহাদের আব সুনিদ্রায় ব্যাঘাত হইবার কোন কারণ থাকিবে না।
নারীর শত্রু শুধু পুরুষ নয়, তাদের শত্রু হিশেবে রয়েছে পুরুষমন্ত্রে দীক্ষিত একপাল নারীও। এরা পুরুষের চর হিশেবে কাজ করে, নারীর সাংঘাতিক ক্ষতি করে।
বাঙালি পুরুষ, সব জাতির পুরুষের মতোই, নারীসাহিত্যকে অনুমোদন করে নি, নারীসাহিত্যকে দেখেছে রান্নাবান্না বা সংসারসেবারূপে; নারী লেখকদের মধ্যে তারা খুঁজেছে আদর্শ স্ত্রীকে। নারী লেখক, বা তার লেখা মূল্যবান নয়। পুরুযের কাছে; তাই বাঙালি নারীসাহিত্যের কোনো ইতিহাস আজো লেখা হয় নি, তাদের প্রতিভার প্রকৃতি বিচার ও মূল্যায়ন হয় নি; এমনকি তাদের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ তথ্যও বেশ দুপ্ৰাপ্য। স্বর্ণকুমারী দেবী, অনুরূপ দেবী, নিরুপমা দেবী, শৈলবালা ঘোষজায়া, সীতা দেবী, শান্ত দেবী ও আরো অনেকের সব বইয়ের নামও খুঁজে পাওয়া যায় না আজ, পাওয়া যায় না তাদের বইয়ের প্রকাশের তারিখ। তাঁরা শিকার হয়েছেন পুরুষতান্ত্রিক উপেক্ষার।
পুরুষ সমালোচকেরা ধরেই নেন তাদের সাহিত্য অপাঠ্য; বিশেষ করে যাদের বই জনপ্রিয় হয়েছিলো তারা সম্পূর্ণ অপাঠ্য, এমন একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে। তাঁদের বইয়ে সমালোচকেরা, যেমন শ্ৰীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (১৩৬৯, ২৮১), খোঁজেন নারীর ‘সুর-বৈশিষ্ট্যের’ পরিচয়। এ-‘সুর বৈশিষ্ট্য’ কিন্তু নারীর নিজস্ব সুর নয়, তারা খোঁজেন নারীর কণ্ঠ থেকে কতোখানি উঠেছে পুরুষের শেখানো সুর। তাঁরা খোঁজেন পুরুষের বিধিবদ্ধ নারীত্ব, যা এক বানানো জিনিশ। পুরুষ তৈরি করেছে নারীর একরাশ ছক : নারী দেবী বা দানবী, নারী অক্রিয়, নারী মাতা, স্ত্রী, কন্যা, সেবিকা, নারীর জীবন ধন্য হয় আত্মোৎসর্গে। পুরুষের চোখে নারী চূড়ান্ত মর্ষকামী, যে ধন্য বোধ ও স্বৰ্গলাভ করে চরম পীড়নের মধ্যে।
নারী এ-ছক মানে নি, কিন্তু বাধ্য হয়েছে মেনে নিতে। বাঙলার নারীরা যখন উপন্যাস লেখায় হাত দেন, তখন কি তারা এ-ছক মেনে চলেন? তারা কি পুরুষতন্ত্রের দীক্ষাকেই পুনঃপ্রচারের জন্যে ধরেন লেখনি? সব নারী ঔপন্যাসিকের সব উপন্যাস আমি পড়ে উঠতে পারি নি,-তাদের বই আজ দুপ্ৰাপ্য; বহু কষ্টে আমি সংগ্ৰহ করেছি ছটি উপন্যাস : স্বর্ণকুমারী দেবীর কাহাকে (১৮৯৮), শৈলবালা ঘোষজায়ার জন্ম-অপরাধী (?), অনুরূপ দেবীর মন্ত্রশক্তি (১৯১৫), নিরুপমা দেবীর দিদি (১৯১৫), ও শ্যামলী (১৯১৮), শান্তা দেবীর জীবনদোলা (?)। এঁরাই আমাদের আদি নারী ঔপন্যাসিক।
এঁরা কেউ জর্জ এলিয়ট, বা বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্ৰ, বুদ্ধদেব বসু, তারাশঙ্কর নন; বাঙলা উপন্যাসধারার কোনো শ্রেষ্ঠ উপন্যাস তারা কেউ লেখেন নি। তাঁরা বেশ গৌণ ঔপন্যাসিক; তবে তাদের গৌণতার মূলে কোনো সহজাত কারণ নেই, রয়েছে সামাজিক কারণ। যে-নারীর সৃষ্টিশীলতাকেই স্বীকার করে নি পুরুষ, তাঁরা কলম ধ’রেই মহান সাহিত্য সৃষ্টি করবেন, এটা আশা করা অন্যায়। তবে ইংরেজি উপন্যাসে যেমন নারী ঔপন্যাসিকেরা তেমনি তারাও পুরুষ-ঐতিহ্যের পাশাপাশি সৃষ্টি করেন একটি গতিশীল অন্তঃস্রোত, সুস্পষ্টভাবে পৃথক এক নারীসাহিত্যধারা। তাঁদের সাহিত্য বহুলাংশে আমূল্যবাদী, এবং নারীকেন্দ্ৰিক; এমনকি যারা রক্ষণশীল, তারাও নারীর দুর্দশার কথা ভুলে যান নি।
আদি বাঙালি নারী ঔপন্যাসিকেরা সাধ্বী স্ত্রীরূপে কলম ধরেন নি, তারা কলম ধরেন। পুরুষতন্ত্রের বহু ছক ভেঙে ফেলার জন্যে। তাঁরা বিশ্বাস করেন নি পুরুষের তৈরি নারীভাবমূর্তিতে, শুরু থেকেই বাঙালি নারী ঔপন্যাসিকেরা ভাবমূর্তির থেকে বেশি গুরুত্ব দেন নারীর বাস্তবতার ওপর, এবং লিপ্ত থাকেন পুরুষের সঙ্গে নিরন্তর বিরোধে। এ-বিরোধ স্বর্ণকুমারী, শৈলবালা, শান্তার মধ্যে তীব্র; অনুরূপা ও নিরুপমা যদিও অনেকখানি দীক্ষিত ছিলেন পুরুষের বিধানে, কিন্তু নারীপুরুষের যখন বিরোধ বেধেছে তখন তারাও পক্ষ নিয়েছেন নারীর।
পুরুষ, স্বামী, বিধাতা প্রভৃতি শব্দ উচ্চারণের সময় নারী ঔপন্যাসিকেরা ভক্তির থেকে অভক্তিই দেখিয়েছেন বেশি, আর জ্ঞাপন করেছেন এমন বাণী যে নারীর দুর্দশার মূলে রয়েছে পুরুষ! নারী ঔপন্যাসিকদের উপন্যাস প্রধানত পুরুষদ্রোহিতার উপন্যাস, যাতে এমন একটি ইঙ্গিত মেলে যে পৃথিবীতে পুরুষ না থাকলে নারীর জীবন সুখের হতো। নারী ঔপন্যাসিকদের নারীদের জীবনে ভয়াবহ শব্দ ‘বিবাহ’, যা নারীদের প্রধান সংকট, যা সম্পন্ন না হলে তাদের জীবন ধ্বংস হয়, আর সম্পন্ন হলেও ধ্বংস হয়।
স্বর্ণকুমারী দেবী প্রথম বাঙালি নারী ঔপন্যাসিক, এবং তিনিই আমার নেয়া পাঁচজনের মধ্যে আধুনিকতম চেতনা সম্পন্ন, শিল্পিতায়ও শ্রেষ্ঠ। তার যে-উপন্যাসটি আমি নিয়েছি, সেটির নাম কাহাকে (১৮৯৮), যাতে কাজ করেছে প্রবল নারীবাদী মনোভাব। দ্য বোভোয়ার নারীর জীবনে প্রেমের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উদ্ধৃত করেছেন বায়রণের যে-দুটি পংক্তি, Man’s love is of man’s life a thing apart/Tis woman’s whole existence, স্বর্ণকুমারী তাঁর উপন্যাস শুরু করেছেন সে-পংক্তি দুটি উদ্ধৃত ক’রে, এবং তার নায়িকা মণি বলেছে :
এ কথা যিনি বলিয়াছেন, তিনি একজন পুৰুষ। পুরুষ হইয়া রমণীর অন্তর্গত প্রকৃতি এমন হুবহু ঠিকটি কি করিয়া ধরিলেন, ভারি আশ্চৰ্য্য মনে হয়। আমি ত আমার জীবনের দিকে চাহিয়া এ কথার সত্যতা অনুভব করি। যতদূর অতীতে চলিয়া যাই, যখন হইতে জ্ঞানের বিকাশ মনে করিতে পারি। তখন হইতে দেখিতে পাই–কেবল ভালবাসিয়াই আসিতেছি, ভালবাসা ও জীবন আমার পক্ষে একই কথা; সে পদার্থটাকে আমা হইতে বিচ্ছিন্ন করিলে জীবনটা একেবারে শূন্য অপদাৰ্থ হইয়া পড়ে-আমার আমিত্বই লোপ পাইয়া যায়।
প্ৰেম সম্পর্কে মণির ব্যাখ্যা অবশ্য দ্য বোভোয়ারের ব্যাখ্যার মতো নয়, তবে সে ক্রমশ এগিয়েছে সে-দিকেই। মণি বা মৃণালিনী কাহাকো নায়িকা, সে নিজের প্রেম ও বিয়ের উপাখ্যান বলেছে নিজেই। নিজের জীবন, প্রেম, ও বিয়ের কাহিনী সে যেভাবে অকপটে বলেছে, তাতেই নষ্ট হয়ে গেছে লজ্জাবতী নারীর ছকটি। মণি অক্রিয় নয়, নিজের গল্প অকপটে বলার মধ্যেই তার সক্রিয়তার পরিচয় মেলে, এবং সে সক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণও করে পরিস্থিতি। সারা উপন্যাসেই টের পাওয়া যায় যে তার শুধু হৃদয় নয়, একটি মস্তিষ্ক রয়েছে, এবং মস্তিষ্কটিই বেশি সক্রিয়। তার জীবনকাহিনী জটিল নয়, এবং সে বাঙলার অধিকাংশ নারীর দুটি অভিশাপ থেকে মুক্ত;–সে দরিদ্রকন্যা নয়, ও অশিক্ষিত নয়; তবু বিয়েই সৃষ্টি করে তার জীবনের সমস্যা।
মণি ছোটো বা বিনয়কুমারের সাথে তার বাল্যপ্ৰেম, যৌবনে ব্যারিস্টার রমানাথের সাথে ব্যর্থ প্রণয়, অবশেষে বাল্যাপ্রেমিক ডাক্তার বিনয়কুমারের সাথে রোমাঞ্চকর রোম্যান্টিক মিলনের কাহিনী অকপটে বলেছে। মণির কথা বলার ভঙ্গি থেকে বোঝা যায় নারীমুক্তি আন্দােলনের বাণীর সাথে সে পরিচিত, আমূল নারীবাদী না হ’লেও সে নারীবাদী। সে পুরুষবিদ্বেষী নয়, কিন্তু পুরুষের সাথে তার লিঙ্গের যে বিরোধ রয়েছে, সেটা কখনো স্পষ্ট কখনো প্রচ্ছন্নভাবে সে জানাতে দ্বিধা করে নি। শুরুতেই নিজের বয়সের কথা বলতে গিয়ে সে বলে, ‘তখন আমার বয়স কত? সাল তারিখ ধরিয়া এখনি তাহা ঠিক করিয়া বলিতে পারিতেছি না … পুরুষে সম্ভবতঃ আমার সারল্যে অবিশ্বাস করিয়া ইহার মধ্য হইতে গৃঢ় অভিপ্ৰায় টানিয়া বাহির করবেন, কিন্তু স্ত্রীলোক বুঝিবেন, বাস্তবিক পক্ষে সাল তারিখ মনে করিয়া রাখা আমাদের পক্ষে কিরূপ কঠিন ব্যাপার। ’
সে ধ’রেই নিয়েছে নারীরা তার কথায় বিশ্বাস করবে, কিন্তু ‘পুরুষে সম্ভবতঃ অবিশ্বাস করবে: অর্থাৎ পুরুষ ও নারী বিশ্বাস করে না পরস্পরকে, তারা জড়িত অবিশ্বাসের সম্পর্কে। শুধু পুরুষকে নয়, পুরুষের মধ্যে যে প্রধান, তাকেও মণি দেখে একই দৃষ্টিতে; সে বলে, ‘বিধাতা পুরুষ তাহা অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছেন। ’ যা সম্ভব হতে পারতো, হওয়াই স্বাভাবিক ছিলো, তা যে অসম্ভব হয়ে উঠেছে, তার মূলে রয়েছে একটি পুরুষ-বিধাতাপুরুষ, যে নারীর প্রতিপক্ষ।
সে যেভাবে নিজের বয়স জানিয়েছে, তাতেও সে ভেঙে ফেলেছে প্রথাগত নারীভাবমূর্তি, প্রকাশ করেছে। পুরুষের সাথে বিরোধ; সে বলেছে, ‘ধরিয়া লওয়া যাক, আমার বয়স তখন আঠার উনিশ, আমি এখনো অবিবাহিত। শুনিয়া কি কেহ আশ্চৰ্য্য হইতেছেন?’ বোঝা যায় তার লক্ষ্য পুরুষ, তার আইবুড়ীত্বে বিস্মিত হবে পুরুষই, কেননা সেটি এক ভিন্ন প্রজাতি।
মণি তার প্রেমের কথা বলেছে অকপটে, প্রেমে প্রথাগত অক্রিয়তার বদলে পালন করেছে সক্রিয় ভূমিকা, অমান্য করেছে পিতৃতান্ত্রিক বিধান যে নারীর প্রেম শুধু স্বামীরই জন্যে। মণি বলেছে, ‘আমি ভালবাসি, বিবাহের পূৰ্ব্বেই ভালবাসি, তিনি যে স্বামী হইবেন, এমনতর আশা করিয়াও ভালবাসি নাই। কেবল তাহাই নহে, এই ভালবাসাই আমার একমাত্র প্রথম ও শেষ ভালবাসা নহে।’ উনিশ শতকের শেষ দশকের পক্ষে খুবই ভয়ঙ্কর কথা বলেছে সে অবলীলায় যে সে ভালোবেসেছে বিয়ের আগেই পুরুষটিকে ভবিষ্যৎ স্বামী ভেবেও ভালোবাসে নি, এবং চরম ভয়ঙ্কর কথা হচ্ছে সে প্রেমে পড়েছে একাধিকবার।
নিষ্ঠাবতী সতী নারীর ভাবমূর্তি সে ভেঙেচুরে দিয়েছে। প্রেমে সে বিশ্বাস করে সাম্যে, শুধু নারীই পুজো করবে প্রেমিককে, আর প্রেমিক পুজো করবে না। প্রেমিকাকে, এটা তার কাছে গ্ৰহণযোগ্য নয়; সে বলেঃ ‘সে রমণীই ধন্য-যে তাহার মনোদেবতার সন্ধান পাইয়া এই পরিপূর্ণ উথলিত আবেগময় প্রাণের পূজায় জীবন সার্থক করিতে পারে; আর সেই পুরুষই ধন্য, যে এই পূজারতা হৃদয়ের দেবতারূপে বরিত হইয়া তাহার পূজায় জীবন উৎসর্গ করিয়া জীবনের উদ্দেশ্য সফল করিতে পারে, আর সেই প্রেমই প্রকৃত প্ৰেম, যাহা এই উভয়ের আত্মহারা পূজায় অধিষ্ঠিত হইয়া প্রবলভাবে চিরবিরাজমান। ’
পুরুষ অবশ্য এমন প্রেমে বিশ্বাস করে না, পুরুষ চায় বহু হৃদয় ও দেহের দেবতা হতে। প্ৰেম সম্পর্কে প্রথাগত ধারণা সে বাতিল করে দিয়েছে স্পষ্টভাবে, শৈশবের প্রেমও যে ইন্দ্ৰিয় কামনাতুর হতে পারে, তাও সে জানিয়েছে; বলেছে, ‘শৈশব ও যৌবনপ্রেমে তফাৎ অল্পই’, বলেছে, ‘ভাবিতাম, ছোটু ত আমাকে চুম্বন করে না; তবে বাবার মত আমাকে ভালবাসে না, আমি কেন তবে ভালবাসিব?’ শৈশবের নিষ্পাপতার মধ্যে সে মিশিয়ে দিয়েছে একটু পাপ, এবং যৌবনের প্রেমকে স্থান দিয়েছে পিতৃপ্রেমের ওপরে; আমি পিতাকে ভালবাসি, তাহার সুখের জন্য আত্মবিসর্জনেও কুণ্ঠিত নহি-কিন্তু তিনি এখন আর আমার জীবনের একমাত্ৰ সুখদুঃখ আশ্রয় অবলম্বন, আকাঙ্ক্ষা কামনা পূজা আরাধনা, দেবতাসৰ্ব্বস্ব নহেন। ’
পিতাকে সরিয়ে দিয়ে সে প্রথাগত কন্যার ভাবমূর্তি বিপন্ন করেছে সম্পূর্ণরূপে। পিতৃতন্ত্রের ভালো লাগতো যদি সে বলতো পিতাই তার দেবতাসর্বস্ব, কিন্তু মণি সেখানে বসিয়েছে তার প্রেমকে, প্রেমিককে। প্রেম তার কাছে যেরূপে দেখা দিয়েছে, তাও সে জানিয়েছে : ‘তাহার পর আট দশ বৎসর কাটিয়া গিয়াছে, তাহার পর আমি ভালও বাসিয়াছি, শৈশবের স্নিগ্ধ কোমল ভালবাসা নহে, যাহাকে লোকে বলে প্রেম–যৌবনের সেই জ্বলন্ত অনুরাগ তাহারও অভিজ্ঞতা জনিয়াছে। ’ মণি অভিনব নারী, যে ছক ভেঙেছে, স্বায়ত্তশাসিত মানুষ হয়ে উঠেছে।
প্রেমে পড়ার প্রথাগত রোম্যান্টিক সূত্রটিকেও সে অস্বীকার করেছে; বলেছে, ‘প্রথম দর্শনেই কি আমি প্ৰাণ সমর্পণ করিয়াছিলাম? মোটেই নহে। ’ সে প্রেমে পড়েছে ধীরে ধীরে, তার বাল্যস্মৃতি তাকে যৌবনে ঠেলে দিয়েছে প্রেমের দিকে। বাল্যকালে পাঠশালায় তার প্রথম প্রেমিক ছোটু যে-গানটি তাকে শুনিয়েছিলো, সেটি অনেক বছর পর সে শুনতে পায় রমানাথের কণ্ঠে: তার ফল হচ্ছে : ‘কিন্তু গানটি গাহিলেই সমস্ত বিপৰ্যয় হইয়া পড়িত। গানটির যে কি মোহ ছিল জানি না, শুনিতে শুনিতে বাল্যের স্মৃতিধারা পূর্ণ প্রবাহে উথলিয়া কুমারহাদয়ের অতৃপ্ত প্ৰেমাকাঙক্ষাকে স্ফীত উচ্ছসিত করিয়া তুলিল।.
তিনি চলিয়া যাইবার পরেও সমস্ত রাত্রি ধরিয়া কেমন মেঘাচ্ছন্ন থাকিতাম-স্বপ্নে জাগরণে ঐ একইরূপ ভাবে আমাকে অভিভূত করিয়া রাখিত; পরদিন নিদ্রােভঙ্গের পর হইতে সে ভাব অল্পে অল্পে দূর হইয়া যাইত। ’ তবে প্রেম নারীজীবনের বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা বিয়ে; মণির জীবনেও বিয়েই বড়ো হয়ে দেখা দেয়। সে দেখতে পায় যাকে সে হৃদয় দিয়েছে, সমাজের চোখে সে তার স্বামী হওয়ার যোগ্য হ’লেও তার হৃদয়ের যোগ্য নয়। ফলে যে-সংকট দেখা দেয়। তার জীবনে, তাতে সে এমন এক অন্তর-বাহ্যিক লড়াইয়ে নামে যাতে সে বদলে দেয় প্রথাগত নারীর ভাবমূর্তি।
বিয়ে হচ্ছে একটি স্বামীর জন্ম, মণিও চারদিকে পরিবৃত হয়ে পড়ে স্বামীর ভাবমূর্তি দিয়ে : ‘চারিদিক হইতেই আমি শুনিতে লাগিলাম, বুঝিতে লাগিলাম, তিনি আমার স্বামী হইবেন, কোন বঙ্গবালার মনে এই বিশ্বাসের কিরূপ প্ৰবল প্রভাব, তাহা বিশেষ করিয়া বলিবার আবশ্যক আছে কি?’ স্বামী সম্পর্কে শিশুকাল থেকেই মেয়েদের মনে তৈরি করা হয় এক দেবভাবমূর্তি, মেয়েরা বড়ো হয় ওই মূর্তিটিকে পুজো ক’রে করে, মণিও তার বাইরে নয়।
স্বামীর যে-ছক তার সামনে ছিলো, সেটি সম্বন্ধে সে বলেছে : ‘স্বামী যেমনই হৌন, তিনি রমণীর একমাত্র পূজ্য আরাধ্য দেবতা, প্রাণের প্রিয়তম, জীবনের সর্বস্ব-এই বাক্য, এই ভাব, এই সংস্কার আজন্মকাল হইতে আমাদের মনে বদ্ধমূল হইয়া বসিতেছে, সুতরাং বিশেষ কারণে স্পষ্ট বীতরাগ না থাকিলে এই বিশ্বাসই প্রেমাঙ্কুরিত করিবার যথেষ্ট কারণ।
মণি, অন্য মেয়েদের মতো, বড়ো হয়েছে স্বামী ভাবমূর্তির পদতলে, ওই পায়ের নিচে নিজের মাথাটি রেখেই বেড়েছে সে; এবং ‘আত্মদানে অন্যকে সুখী করিব নারীপ্রকৃতির এই যে সৰ্ব্বগ্রাসী আকাঙক্ষা, ইচ্ছাপ্রবণতা, নারীপ্রেমের শিরায় মজায় যে আকাঙক্ষা শোণিতাকারে প্রবাহিত বৰ্ত্তমান, তাহার সফলতাতেই, তাহার বিশ্বাসেই রমণী-হৃদয় পরিপূর্ণ, বিকসিত, জীবনজন্ম সার্থক, চরিতার্থ; আবার এ বিশ্বাসেই সে ভ্রান্ত, কলঙ্কিত, মহাপাপী।
প্ৰেমময়ী রমণী ইহার জন্য কতদূর আত্মত্যাগ করিতেছে; আর কতদূর না করিতে পারে?’ তবে স্বামী ভাবমূর্তির পায়ে আত্মদানের পাশাপাশি সব নারীই পোষে স্বামী ভাবমূর্তির সাথে একটা বিরোধ, এটা নারী ঔপন্যাসিকদের প্রায় সব উপন্যাসেই স্পষ্ট বা প্রচ্ছন্নভাবে দেখা যায়, এবং মণির মধ্যে তা স্পষ্ট দেখা দেয় প্রেমে পড়ার অল্প পরেই।
বাঙালি নারীকে পিতৃতন্ত্র দিয়েছে স্বামীভক্তির পাঠ, পুরুষে আস্থা; কিন্তু বাঙালি নারীপুরুষের সম্পর্ক একটু ঘাটলে ধরা পড়ে তাদের পারস্পরিক অনাস্থা। পুরুষ তার নারী-অনাস্থ উচ্চকণ্ঠে প্রচার করে আসছে পিতৃতন্ত্রের শুরু থেকে, নানা সংহিতা লিখেছে নারীঘৃণার; আর নারী তা বিষের মতো লালন করে এসেছে নিজের বুকে। মণি যার ওপর আস্থা স্থাপন করতে যাচ্ছিলো, অচিরেই তার ওপর তার আস্থা নষ্ট হয়ে যায়।
যে-রমানাথের সঙ্গে সে প্রণয়ে জড়িত, যে তার স্বামী হ’তে যাচ্ছে, মণি জানতে পারে সে সৎ নয়; বিলেতে সে এক নারীকে কথা দিয়েছিলো। মণি বলেছে, ‘স্বপ্নে দেখিলাম, যেন আমার বিবাহ হইতেছে, আমি আগ্রহদৃষ্টিতে বরের দিকে চাহিলাম, কিন্তু মনে হইল, এ সে নাহে। ’ শুরু হয় তার সংকট; সে নতুন প্ৰজাতির নারী, যে প্রথাগত ছক অনুসারে চলে না। তার প্রেম বিপর্যস্ত, তবে সে নিজে বিপর্যস্ত নয়।
সে বলেছে, ‘কিন্তু এ নৈরাশ্যে করুণ কষ্টের দারুণতা, অসহনীয়তা উপলব্ধি করিলাম না; কিংবা সে যেমনই হৌক, তবু আমার দেবতা-তবু তাহার চরণে হৃদয় বিকাইব, মনে এমনতর ভাবেরও উদয় হইল না। পরিপূর্ণ বিশ্বাসে প্রতারিত বোধ করিয়া এ যেন প্রত্যাখ্যাত ভিক্ষুক দুৰ্ব্বাসা মুনির ন্যায় গৰ্ব্বাহত নিরাশাক্ষুব্ধ হইলাম, প্রতারকের উপর ভীষণ ক্রোধের উদয় হইল। কেবল তাহার উপর নহে, নিজের উপরেও ক্রুদ্ধ হইলাম-কি করিয়া আমি এমন লোককে দেবতা মনে করিয়াছিলাম!’
প্রথাগত কতকগুলো বিশ্বাস ও বোধ সে ত্যাগ করেছে : প্রণয়সম্পর্ক নষ্ট হওয়ায় সে ‘করুণ কষ্টের দারুণতা, অসহনীয়তা উপলব্ধি’ করে নি, যা তার কাছে প্রত্যাশিত ছিলো, এবং ‘সে যেমনই হৌক, তবু আমার দেবতা-তবু তাহার চরণে হৃদয় বিকাইব, মনে এমনতর ভাবেরও উদয় হইল না।’ সে পুরুষের ছক অনুসারে তৈরি নয়, প্রতারককে দেবতা গণ্য করার বদলে তার ওপর সে হয় ক্রুদ্ধ।
তার বোন তার মতো নয়, সে পুরুষের ছক অনুসারী; তার দিদি তার কাছে তুলে ধরে পুরুষতান্ত্রিক বাস্তব পরিস্থিতি : ‘সে পুরুষ মানুষ, তার কি, তোর সঙ্গে না হ’লে এখনি অন্য আর একজন সেধে মেয়ে দেবে, আর তোর নামে এ থেকে এত কথা উঠবে যে, পরে বিয়ে হওয়াই ভার হবে। ’ পুরুষতন্ত্রে পুরুষ চিরনিষ্পাপ, সে দণ্ডিত হওয়ার বদলে পায় পুরস্কার; তার জন্যে নারীর অভাব হয় না, বরং নারীরাই অভাব বোধ করে তার। মণি ছকভাঙা; সে জানায়, নাই বা বিয়ে হ’ল, আমি ত সেজন্য কিছুমাত্র ব্যস্ত নই। ’ ছক থেকে স’রে এসেছে সে, বিয়েকে সে নিয়তি মনে করে না।
নারীর জন্যে পুরুষ মানদণ্ড স্থির ক’রে রেখেছে, তাকে হ’তে হবে সতীসাধ্বী; মণি স্বামীর জন্যে স্থির করে নতুন মানদণ্ড : ‘যে আমার ক্ষমার পাত্ৰ, সে আমার প্রণয়ী আমার স্বামী হইবার যোগ্য নহে; আমার স্বামীতে আমি সুর্যের মত জ্যোতিষ্মান গৌরবমণি দেখিতে চাই। সংসার যেমনই হৌক, পৃথিবীতে সে আমাকে স্বৰ্গ দেখাইবে, আমি তাহাতে দেবতা পাইব। ’
পুরুষ যেমন জন্মজন্মান্তর ধ’রে সতী চায়, মণিও চায় সৎ পুরুষ : ‘আমার স্বামীর বর্তমানটুকু লইয়াই আমি সস্তুষ্ট নহি, অতীতে, বৰ্ত্তমানে ভবিষ্যতে তাহার সমস্ত জীবনে আমি আপনাকে বিরাজিত দেখিতে চাই, তাহার জীবনের কোন ভাগ যে আমাছাড়া ছিল বা তাহার সম্ভাবনা আছে, আমার সৰ্ব্বগ্রাসী প্ৰেমাকাঙ্ক্ষা এ চিন্তা সহ্য করিতে পারে না, এ সম্বন্ধে আমার হৃদয় পুরুষের ন্যায়, পুরুষ পত্নীতে যেরূপ অক্ষুন্ন অমর পবিত্ৰতা, অনাদি অনন্ত নিষ্ঠতা চাহেন, আমি তেমন আমার স্বামীর সমস্ত জীবনই আমার বলিয়া অনুভব করিতে চাহি৷’
এতোদিন ধরে নারীর কাছে পুরুষ যা চেয়ে এসেছে, মণি তা-ই দাবি করে পুরুষের কাছেঃ দ্বৈতমানদণ্ড লোপ ক’রে দিয়ে সে হয়ে উঠেছে। পুরুষের সমান : ‘আমি কি করিয়া বুঝাইব যে, আমি তাঁহাকে ক্ষমা করিতে পারি, বিবাহ করিতে পারি–তিনি আমার স্বামী হইতে পারেন। কিন্তু আমার হৃদয়ের আদর্শ আকাঙক্ষা তিনি পূর্ণ করিতে পরিবেন না… রমণীতে এরূপ পৌরুষিক হৃদয়ভাবের কি সহানুভূতি আছে?’ মণি তার হৃদয়ভাবকে ‘পৌরুষিক’ বলে আখ্যা দিয়েছে, তবে সেও জানে ভাবে কোনো লৈঙ্গিক পার্থক্য নেই; সংস্কৃতিই ওই পার্থক্য সৃষ্টি ক’রে রেখেছে। সে অস্বীকার করেছে ওই লৈঙ্গিক পার্থক্যটুকু।