কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই

বার্ট্রান্ড রাসেল

০১. ধার্মিক বুর্জোয়া এবং অধার্মিক সর্বহারা

পোস্ট টপিক

[প্রথম খন্ড]

[১৯২৭ সালের মার্চ মাসের ৬ তারিখে জাতীয় ধর্ম-নিরপেক্ষ সমাজের দক্ষিণ লন্ডন শাখার দ্বারা আয়োজিত বাটেরেসা টাউন হলে উক্ত বিষয়ে এক ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানে বাট্রান্ড রাসেলের দ্বারা প্রদত্ত ভাষণ]

এতক্ষণ আপনাদের সামনে শ্রদ্ধেয় সভাপতি মহাশয় যে বিষয়ে তাঁর বক্তব্য রাখলেন উক্ত বিষয় প্রসঙ্গে এই মনোজ্ঞ রাতে আমি আমার বক্তব্য পেশ করতে চলেছি। বিষয়টি হল, কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই। এই বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদের প্রথমেই ভালো করে বুঝতে হবে যে একজন ব্যক্তি ধর্মবিশ্বাসী বা খ্রীস্টান বলতে ঠিক কী বোঝে। বর্তমানে বহু মানুষ এই শব্দটিকে খুবই হাল্কা অর্থে ব্যবহার করে থাকেন। কিছু কিছু মানুষ এই শব্দটির দ্বারা সেই সব মানুষদের বোঝেন যারা তাদের জীবনকে সৎ, সুন্দর ও মঙ্গলজনক পথে পরিচালিত করতে চায়।

যদি খ্রীস্টান শব্দটির অর্থ এই হয়, তবে আমি বলব সমস্ত জাতি ধর্মে যারাই সৎ, সুন্দর ও মঙ্গলজনক পথে নিজেদের পরিচালিত করেছেন তারাই খ্রীস্টান। ভাবার্থের দিক থেকে খ্রীস্টান শব্দটিই যে কেবল সৎ সুন্দর মঙ্গলজনক জীবনের অর্থ বহন করে তা আমি মনে করি না, কেননা যারা খ্রীস্টান নন অর্থাৎ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী, কনফুসীয় ধর্মাবলম্বী কিংবা মহম্মদীয় ধর্মাবলম্বী বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী, তারা যেহেতু খ্রীস্টান নন, তাই তারা সৎ, সুন্দর ও মঙ্গলজনক জীবন অতিবাহিত করবার চেষ্টা করছেন না। আমি খ্রীস্টান অর্থে সেই সব মানুষদের কথাও বলছি না, যারা নিজেদের আলোয় সুন্দরভাবে জীবনকে চালাবার চেষ্টা করেন।

আমি কেবল মনে করি, নিজেকে একজন খ্রীস্টান বলে মনে করার অধিকার পেতে গেলে আপনাকে অবশ্যই সেই নির্দিষ্ট পরিমাণ বিশ্বাসের অধিকারী হতে হবে, যে বিশ্বাসের দ্বারা আপনি নিজেকে একজন খ্রীস্টান বলতে পারবেন। একটা কথা আপনাদের মনে রাখতেই হবে যে খ্রীস্টান শব্দটি সেন্ট অগস্টাইন এবং সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাসের সময় যে পূর্ণ অর্থ বা প্রাণ-পূর্ণ রক্তিম অর্থে ব্যবহার হত সেই অর্থে শব্দটিকে বর্তমানে ব্যবহার করা হয় না। অর্থাৎ ব্যাপারটি অনেকটা এইরকম, যেমন–আপনি পৃথিবীর সমস্ত ধর্মমতকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করলেন, যে ধর্মমতগুলি যথার্থরূপে নিজের নিজের ক্ষেত্রে বিকশিত এবং সেইসব ধর্মমতের প্রতিটি অক্ষরকে আপনি বিশ্বাস করেন আপনার দৃঢ় বিশ্বাসের পূর্ণ শক্তিতে।

 

ঈশ্বর বিশ্বাস বলতে কী বোঝায়?

বর্তমানে ঈশ্বর বিশ্বাস ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধ নয়। খ্রীস্টান শব্দটির অর্থ আমরা ক্রমশই অস্পষ্টরূপে বুঝতে বাধ্য হচ্ছি। কেননা, আমি মনে করি যে, দুটি স্বতন্ত্র বিষয় সেই ব্যক্তির জন্য একান্ত অপরিহার্য যে ব্যক্তি নিজেকে একজন খ্রীস্টান বলতে চায়। বিষয়টি হল নিশ্চিতভাবে কথিত কিন্তু প্রমাণহীন– অর্থাৎ আপনাকে অবশ্যই ঈশ্বর ও তার অমরত্বের উপর বিশ্বাসপরায়ণ হতে হবে। যদি এই দুটি বিষয়ে আপনি বিশ্বাসী না হন, তবে আমার মনে হয় না যে আপনি নিজেকে একজন যাথার্থ ঈশ্বরবিশ্বাসী বলতে পারেন। এরপরেও, আর কিছুটা এগিয়ে বলা যায়, ধর্মটি যার নামে নামাঙ্কিত, সেই খ্রীস্টের উপর আপনার এক ধরনের বিশ্বাস থাকা প্রয়োজন।

উদাহরণস্বরূপ, মহম্মদীয় ধর্মাবলম্বীরাও ঈশ্বর ও তার অমরত্বের উপর বিশ্বাসপরায়ণ অথচ তারা নিজেদের খ্রীস্টান বলে মনে করে না। আমি মনে করি, কিছু না হলেও খ্রীস্টের উপর আপনার এই বিশ্বাস অবশ্যই আছে যে তিনি যদি স্বর্গীয় না-ও হন, অন্তত তিনি সমস্ত মানুষের চেয়ে উত্তম ও জ্ঞানী মানুষ। যদি আপনি খ্রীস্টের উপর বেশিরভাগ বিশ্বাসটি না করে উঠতে পারেন, তা হলে আমি মনে করি না যে আপনার নিজেকে একজন খ্রীস্টান বলে ডাকার অধিকার আছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে হুইটেকারের পঞ্জিকা থেকে আপনারা আর একরকম পথের সন্ধান পেয়েছেন এবং ভূগোলের বইগুলি থেকে আপনারা জানতে পেরেছেন যে পৃথিবীর সমগ্র জনগণকে খ্রীস্টীয়, মহম্মদীয়, বৌদ্ধ ও কৃতাসম্পন্ন উপাসক সম্প্রদায় এবং আরও বহু ধরনের সম্প্রদায়ে বিভক্ত করা হয়েছে, কিন্তু এরকম ভাবে ধরলে আমরা সবাই খ্রীস্টান। ভূগোলের বইগুলিতে আমরা সবাই নিজেদের জাতি সম্প্রদায়ের নামে তালিকাভুক্ত, কিন্তু তা কেবলমাত্র জ্ঞানের দাবিতেই, অন্য কিছু নয়। বর্তমান আলোচনার ক্ষেত্রে এই প্রসঙ্গটিকে আমরা পাশ কাটিয়ে যেতে পারি।

এইজন্য উক্ত বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে যখন আমি আপনাদের বলে থাকি যে আমি কেন খ্রীস্টান নই, তখন আমি আপনাদের দুটি বিভিন্ন বিষয় বলতে বাধ্য হই, প্রথমত, কেন আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না এবং বিশ্বাস করি না তার অমরত্বে এবং দ্বিতীয়ত, কেন আমি মনে করি না যে যীশু খ্রীস্ট সমগ্র মানুষের থেকে জ্ঞানী ও উত্তম মানুষ, যদিও আমি তার মঙ্গলময় নৈতিকতা সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করে থাকি।

কিন্তু অতীতে ঈশ্বর-অবিশ্বাসীদের সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমি ঈশ্বরবিশ্বাস সম্পর্কে তাদের মতো স্থিতিস্থাপক কোন ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করে নিতে পারিনি। আমি আগেই বলেছি যে প্রাচীন কালে এই শব্দটিকে পূর্ণ রক্তিম চেতনার সঙ্গে ব্যবহার করা হত। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, শব্দটির নিষ্পত্তি ঘটে নরক-বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে। শাশ্বত নরকের বিশ্বাসে খ্রীস্টানদের কাছে কিছুদিন আগে পর্যন্ত আগুন একটি অনিবার্য উপাদান ছিল।

আপনারা জানেন, এই দেশে প্রিভি কাউন্সিলের সিদ্ধান্তের ফলে অনিবার্য উপাদান হিসেবে আগুনকে বাদ দেওয়া হয়েছে এবং এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্যান্টারবারির আর্কবিশপ ও ইয়র্কের আর্কবিশপের মধ্যে মতভেদও হয়েছে, কিন্তু এই দেশে, আমাদের ধর্ম পার্লামেন্টের অ্যাট বা সংসদীয় আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ফলে প্রিভি কাউন্সিল এই জঘন্য করুণাকে পদদলিত করবার সামর্থ্য অর্জন করতে পেরেছে এবং খ্রীস্টানদের কাছে নরকের প্রয়োজনীয়তা আর বেশি দিন থাকতে পারেনি। ফলস্বরূপ আমিও কোন খ্রীষ্টানকে নরকে বিশ্বাসী হবার জন্য উৎসাহিত করব না।

 

ঈশ্বরের অস্তিত্ব

ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রশ্নে আসতে গেলে, প্রশ্নটি যেমন বড় হবে তেমনই তা ভাবগম্ভীর হবে। যদি আমার পক্ষে এই ধরনের প্রশ্ন ঠিক করা সম্ভব হত তবে আমি ঈশ্বরের রাজত্ব আসার আগে পর্যন্ত আপনাদের এখানেই ধরে রাখতাম, যাতে আপনারা আমাকে ক্ষমা করতে পারতেন প্রশ্নটি অপেক্ষাকৃত জোর করে করার জন্য। আপনারা জানেন যে ক্যাথলিক চার্চ ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্পর্কে এই মতো পোষণ করে থাকে যে ঈশ্বরকে প্রমাণ করা যেতে পারে অসহযোগিতামূলক বিচার শক্তি (Unaided Reason) দ্বারা। এই ধরনের মতবাদ কিছুটা কৌতূহলোদ্দীপক হলেও তাদের অনেকগুলি মতবাদের মধ্যে এটাও একটি।

এই ধরনের মতবাদ তারা প্রচার করেছিল এই কারণে যে কোন একটি সময় মুক্তচিন্তাবিদরা প্রায়শই সেইসব বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক উত্থাপন করে দেখাতেন যেগুলি ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিপক্ষে ব্যবহার করা যেতে পারে, কিন্তু সেইসব মুক্তচিন্তাবিদরা জানতেন যে তাদের বিশ্বাসের দিক থেকে ঈশ্বর অবশ্যই বিদ্যমান। এই বিষয়ে যুক্তিপ্রদর্শন ও তর্কবিতর্ক এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেল যে, ক্যাথলিক চার্চ অনুভব করল, এগুলোর অবশ্যই থাকার প্রয়োজন আছে। এইজন্যই তারা এই ধরনের মতবাদ প্রচার করল যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যেতে পারে অসহযোগিতামূলক বিচারশক্তির দ্বারা এবং তারা সেই ধরনের তর্কবিতর্কগুলিকেই সামনে রেখেছে যেগুলি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের স্বপক্ষে যেতে পারে। এই ধরনের অনেকগুলি যুক্তি আছে, কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র কয়েকটিকে নিয়েই আমরা আলোচনা করব।

 

প্রথম-কারণের উপর বিতর্ক

প্রথম কারণের ওপর আলোচনাটি বোঝাবুঝির দিক থেকে সব থেকে সরল ও সোজা [আমাদের আগেই বুঝে রাখা দরকার যে জগতের যা কিছু আমরা দেখতে পাই, সবকিছুর একটি কারণ আছে। এই কারণকে প্রশ্ন করতে করতে আপনি পেছনের দিকে এগিয়ে গিয়ে অবশ্যই প্রথম কারণের (First cause) সম্মুখীন হবেন, এবং এই প্রথম কারণকেই আপনি ঈশ্বর বলে অভিহিত করেন।]

আমি মনে করি উক্ত বিতর্কটি বর্তমান যুগের পরিপ্রেক্ষিতে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ, প্রথমত যে কারণটিকে ব্যবহার করা হবে সেটি সম্পূর্ণ নয়। দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা উক্ত কারণের উপর কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন, যে কারণটি মোটেই তেমন প্রাণবন্ত নয় যেমনভাবে অতীতে তাকে প্রাণবন্ত করে দেখানো হত। কিন্তু এতদ্বতিরিক্ত আপনি একটি যুক্তি দেখাতে পারেন যে প্রথম কারণ বলে একটি কারণ অবশ্যই আছে যার কোন বৈধতা নেই। যখন আমি যুবক ছিলাম তখন এই প্রশ্নগুলি নিয়ে নিজের মনেই ভাবগম্ভীর তর্ক-বিতর্ক চালিয়েছিলাম।

প্রথম কারণের উপর বিতর্ক আমি বহুদিন ধরে গ্রহণ করেছিলাম, কিন্তু একদিন, যখন আমার বয়স আঠারো, আমি জন স্টুয়ার্ট মিলের আত্মজীবনী পড়লাম, এবং সেখানে এই বাক্যটি দেখলাম : আমার বাবা আমাকে এই প্রশ্নগুলি শেখালেন, ‘কে আমাকে তৈরি করেছে?’ আমার দ্বারা এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়নি কিন্তু এই ধরনের প্রশ্ন আমাকে সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন করার পথে নিয়ে গেল, সেটি হল, ‘কে ঈশ্বরকে তৈরি করেছে?’ আমি এখনও মনে করি এই সরল বাক্যটি প্রথম কারণ সম্পর্কিত যুক্তির দোষটি সেই প্রথম আমাকে দেখালো।

যদি প্রতিটি জিনিসের একটি কারণ থাকে তবে ঈশ্বরেরও কারণ আছে (If everything mrust have cause, then god must have a cause)। যদি কারণ ছাড়াই কোন কিছু থাকতে পারে তবে তা ঈশ্বরের জগৎ সম্পর্কেও সমানভাবে প্রযোজ্য। সুতরাং যুক্তি-তর্কের আর কোন মূল্যই থাকে না। এই ব্যাপারটি অনেকটা হিন্দুদের দৃষ্টিভঙ্গির মতো, যেমন জগৎ একটি হাতির উপর অবস্থান করছে এবং হাতিটি একটি কচ্ছপের উপর অবস্থান করছে এবং যখন কেউ প্রশ্ন করে কচ্ছপটি কার উপর অবস্থিত? তখন ভারতীয়রা বলে থাকে মনে হয় আমরা বিষয়টিকে পরিবর্তন করছি।

সত্যি করে বলতে গেলে এর থেকে ভালো যুক্তি আর নেই। কোনরকম কারণ ছাড়াই জগৎ বর্তমান অস্তিত্বে আসতে পেরেছে এরকম ভাবার যেমন কোন কারণ নেই, অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, এরকম কি কোন কারণ থাকতে পারে যে কেন জগতের সর্বদাই বিদ্যমান থাকা উচিত হয়নি। এরকম ভাবারও কোন কারণ নেই যে পৃথিবীর একটি শুরু ছিলো। আমাদের কল্পনার অভাবেই আমাদের এরকম ভাবতে হয় যে, বস্তুসমূহের অবশ্যই একটি শুরু ছিল। এই জন্য আমি প্রথম কারণের যুক্তির উপর অযথা সময় নষ্ট করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি না।

 

প্রাকৃতিক আইন সম্পর্কিত যুক্তি

প্রাকৃতিক আইন থেকে একটি অতি সাধারণ যুক্তি পাওয়া যেতে পারে, যে যুক্তিটি সমগ্র অষ্টাদশ শতক ধরে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, বিশেষত, স্যার আইজ্যাক নিউটন ও তাঁর বিশ্বতত্ত্বের প্রভাবের ফলে। মাধ্যাকর্ষণের সূত্র অনুযায়ী সাধারণ মানুষ এই সত্যটি জানলে যে সমস্ত গ্রহগুলি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে এবং তারা মনে করল যে ঈশ্বর এসমস্ত গ্রহগুলিকে এই বিশেষভাবে ঘোরার আদেশ দিয়েছিলেন বলেই তারা ওই ভাবে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে।

তাদের এই ভাবনাটি এত সরল ও সোজা ছিলো যে তার ফলে তাদের মাধ্যাকর্ষণের সূত্রটিকে আরও খতিয়ে দেখার সমস্যাকে গ্রহণ করতে হয়নি। কিন্তু আইনস্টাইনের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে এই মাধ্যাকর্ষণের সূত্রটির ব্যাখ্যা আমাদের কাছে কিছুটা জটিল হয়ে পড়ল। নিউটনীয় ব্যবস্থায় যে ব্যাখ্যাটি অতি দ্রুত দেওয়া যেত, এখন থেকে তা আর হল না, কেননা যে ভাবেই হোক ব্যাখ্যাটি সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়ল। আইনস্টাইন কিভাবে মাধ্যাকর্ষণের সূত্রটিকে ব্যাখ্যা করেছেন সে সম্পর্কে আমি কোন ভাষণ দিতে চাই না, কারণ তা কিছুটা সময় নিয়ে নেবে, তবে সেই নিউটনীয় ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক আইনটিকে আপনারা আর বেশিদিন ধরে থাকতে পারলেন না, যেখানে, কোন কারণবশত কেউ বুঝে উঠতে পারেনি, কেন প্রকৃতি সমরূপ ধরনের (Uniform fashion) আচরণ করে থাকে।

এবার আমরা বুঝতে পারলাম অনেক কিছু, যাদেরকে আমরা প্রাকৃতিক আইন বলে মনে করতাম সেগুলো বাস্তবে বিভিন্ন মানবিক প্রথা (Human connection)। আপনারা জানেন যে বহুদূরবর্তী তারকামণ্ডিত অনন্তেও তিন গজে এক ফুট হয়। এটা নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, কিন্তু আপনি এই ব্যাপারটি প্রাকৃতিক আইন বলে ভাবতে পারেন না এবং এইরকম বহু জিনিস যাকে আমরা প্রাকৃতিক আইন ভেবে থাকি, আসলে সেগুলো উক্ত ঘটনাটির মতো। অন্যদিকে, পরমাণুগুলো কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কিত বিষয় যদি আপনি জানেন তবে দেখবেন যে সেগুলো ঠিক তেমনভাবে প্রাকৃতিক আইন মেনে কাজ করে না যেমনভাবে সাধারণ মানুষ ভাবে। আপনি যে-সব প্রাকৃতিক আইনগুলি সম্পর্কে জানেন সেগুলো পরিসংখ্যানগত গড় হিসেবে আকস্মিক ঘটনা থেকে উদ্ভূত।

এরকম একটি ঘটনার কথা বলা যেতে পারে যা বলতে গেলে আমরা সবাই জানি। পাশাখেলার ক্ষেত্রে দেখা যায় ছত্রিশবার দান ফেললে আপনি একবার হঠাৎ দুটি ছয়ের দান ফেলতে পারেন, এর জন্য আপনি এরকম মনে করতে পারেন না যে আপনার দানের ক্ষেত্রে এই রকম ঘটনা কোন একটা নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। অন্যভাবে বলা যায় যে প্রতি ছত্রিশবারে যদি একবার দুটো ছক্কা পড়ে তবে বলা যেতে পারে যে ব্যাপারটি একটা নিয়মে চলছে। প্রাকৃতিক আইনগুলি বহু ক্ষেত্রেই অনেকটা এইরকম।

পরিসংখ্যানগত গড় হিসেবের দিক থেকে তারা প্রায় সবাই আকস্মিকতার আইন (Laws of chance) থেকে উদ্ভূত এবং এই ধরনের ঘটনার ফলে পূর্বের তুলনায় বর্তমানে প্রাকৃতিক আইনগুলিকে অনেক কম মর্মস্পর্শী বলে মনে হয়। এর থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে বলা যেতে পারে যে উপযুক্ত আইনগুলি বিজ্ঞানের ক্ষণিক পরিস্থিতির (Momentary state of science) প্রতিনিধিত্ব করলেও কাল সেগুলো বদলে যেতে পারে। প্রাকৃতিক আইনই মূলত আইন প্রণেতা এই ধরনের সমগ্র ধারণাটি প্রাকৃতিক আইন ও মানবিক আইনের মধ্যে একটা বিভ্রান্তির ফলেই ঘটেছে।

মানবিক আইনগুলো এমন কতকগুলি আদেশ যা কোন একটি নির্দিষ্ট পথে আপনার আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করে, যে পথে আপনি আচরণ করতেও পারেন, আবার না-ও করতে পারেন সেটা আপনার পছন্দের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু প্রাকৃতিক আইন হল বস্তুর বাস্তব আচরণের বর্ণনা এবং প্রাকৃতিক আইনগুলো বস্তুর বাস্তব আচরণের বর্ণনা বলেই আপনি কখনও এই ধরনের তর্ক উত্থাপন করতে পারেন না যে, কেউ বস্তুগুলোকে ঠিক ওই ধরনের আচরণ করতে আদেশ দিয়েছে, কেননা যদি আপনি এই ধরনের কথা বলেন তবে প্রশ্ন উঠবে, কেন ঈশ্বর অন্য কিছু না করে ঠিক এমন ধরনের প্রাকৃতিক আইন তৈরি করলেন?’

তখন যদি আপনি বলেন যে তিনি তাঁর আনন্দের জন্যেই এই ধরনের প্রাকৃতিক আইন তৈরি করেছেন এবং যার কোন কারণ নেই, তখন আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন যে এখানে এমন কিছু একটা আছে যা আইনের বিষয়বস্তু নয় এবং সেখানেই আপনার প্রাকৃতিক আইন সম্পর্কিত ধারণা বিঘ্নিত হবে। যদি আপনি গোঁড়া ধর্মবেত্তাদের মতো অনুসরণ করে এই কথা বলেন যে ঈশ্বর সর্বোত্তম বিশ্ব সৃষ্টি করবার জন্যেই কেবল এই ধরনের আইনের সৃষ্টি করেছেন, অন্য আর কোন কারণ নেই, তবে যেভাবে ব্যাপারটিকে আপনি কখনই ভেবে দেখেননি, সে ভাবেই বলতে হয়, যে যদি প্রাকৃতিক আইনগুলি ঈশ্বরেরই রচনা এইরূপ কারণ থাকে তবে ঈশ্বর নিজেও উক্ত আইনের বশবর্তী এবং এই কারণেই ঈশ্বরকে মধ্যস্থ কোন সত্তা বলে পরিচিত করানোর মধ্যে কোন লাভ নেই।

আপনার স্বর্গীয় আদেশের বাইরে ও সম্মুখে সত্যই একটি আইন আছে এবং ঈশ্বর আপনার উদ্দেশ্যকে কখনই সফল করে তুলতে পারবেন না, কেননা তিনি কখনই কোন আইনপ্রণেতা নন। সংক্ষেপে, প্রাকৃতিক আইন সম্পর্কে সমগ্র যুক্তি আগে যে শক্তির সঙ্গে ব্যবহৃত হত এখন তা আর রইল না। বিষয়গুলি সম্পর্কে সমালোচনা করার জন্য আমি ঠিক সময়েই এগিয়ে চলেছি। বিষয়টি হল ঈশ্বরের অস্তিত্বকে নিয়ে যা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। এই বিষয়গুলি প্রথমে ছিল যথেষ্ট কঠিন ও বুদ্ধিদীপ্ত, কিন্তু অবশ্যই ভ্রমাত্মক ছিল । আমরা আধুনিক যুগে প্রবেশ করা মাত্রই তারা বুদ্ধিগত দিক দিয়ে কম সম্মানিত হয়ে পড়ল এবং ক্রমশ এক ধরনের নৈতিক অস্পষ্টতার দ্বারা আক্রান্ত হল।

 


কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই

0 0 votes
Post Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
মন্তব্য করুনx
()
x
Scroll to Top
Scroll to Top