বিকেলের দিকে রাজেনবাবুর বাড়িতে যাবার কথা ফেলুদা বলছিল, দুপুর থেকে মেঘলা করে চারটে নাগাত তেড়ে বৃষ্টি নামল। আকাশের চেহারা দেখে মনে হল বৃষ্টি সহজে থামবে না। ফেলুদা সারাটা সন্ধে খাতা-পেনসিল নিয়ে কী সব যেন হিসেব করল। আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছিল কী লিখছে, কিন্তু জিজ্ঞেস করতে সাহস হল না। শেষটায় আমি তিনকড়িবাবুর বইটা নিয়ে পড়তে আরম্ভ করলাম। দারুণ থ্রিলিং গল্প। পড়তে পড়তে রাজেনবাবুর চিঠির ব্যাপারটা মন থেকে প্রায় মুছেই গেল।
আটটা নাগাত বৃষ্টি থামল। কিন্তু তখন এত শীত যে, বাবা আমাদের বেরোতে দিলেন না। পরদিন ভোরবেলা ফেলুদার ধাক্কার চোটে ঘুম ভাঙল। ‘ওঠ্, ওঠ্–এই তোপ্সে–ওঠ!’
আমি ধড়মড়িয়ে উঠে পড়লাম। ফেলুদা কানের কাছে মুখ এনে দাঁতে দাঁত চেপে এক নিশ্বাসে বলে গেল, ‘রাজেনবাবুর নেপালি চাকরটা এসেছিল। বলল, বাবু এখুনি যেতে বলেছেন–বিশেষ দরকার। তুই যদি যেতে চাস তো–‘
‘সে আর বলতে!’
পনেরো মিনিটের মধ্যে তৈরী হয়ে রাজেনবাবুর বাড়িতে পৌঁছে দেখি, তিনি ফ্যাকাশে মুখ করে খাটে শুয়ে আছেন। ফণী ডাক্তার তাঁর নাড়ি টিপে খাটের পাশটায় বসে, আর তিনকড়িবাবু এই শীতের মধ্যেও একটা হাতপাখা নিয়ে মাথার পিছনটায় দাঁড়িয়ে হাওয়া করছেন। ফণীবাবুর নাড়ি দেখা হলে পর রাজেনবাবু যেন বেশ কষ্ট করেই জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে বললেন, ‘কাল রাত্রে–বারোটার কিছু পরে ঘুমটা ভাঙতে বিদ্যুতের আলোয় আমার মুখের ঠিক সামনে আই স এ মাস্ক্ড্ ফেস্!’
মাস্ক্ড্ ফেস্! মুখোস পরা মুখ!
রাজেনবাবু দম নিলেন। ফণী মিত্তির দেখলাম একটা প্রেস্ক্রিপ্শন লিখছেন। রাজেনবাবু বললেন, ‘দেখে এমন হল যে চিৎকারও বেরোল না গলা দিয়ে। রাতটা যে কীভাবে কেটেছে–তা বলতে পারি না।’
ফেলুদা বলল, ‘আপনার জিনিসপত্তর কিছু চুরি যায়নি তো?’
রাজেনবাবু বললেন, ‘নাঃ, তবে আমার বিশ্বাস, আমার বালিশের তলা থেকে আমার চাবির গোছাটা নিতেই সে আমার উপর ঝুঁকেছিল। ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে জানালা দিয়ে লাফিয়ে…ওঃ হরিব্ল্, হরিব্ল্!’
ফণী ডাক্তার বললেন, ‘আপনি উত্তেজিত হবেন না। আপনাকে একটু ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি। আপনার কম্প্লিট রেস্টের দরকার।’
ফণীবাবু উঠে পড়লেন। ফেলুদা হঠাৎ বলল, ‘ফণীবাবু কাল রাত্রে রুগি দেখতে গেস্লেন বুঝি? কোটের পিছনে কাদার ছিটে লাগল কী করে?’
ফণীবাবু তেমন কিছু না ঘাবড়িয়ে বললেন, ‘ডাক্তারের লাইফ তো জানেনই–আর্তের সেবায় যখন জীবনটাই উৎসর্গ করিচি, তখন ডাক যখনই আসুক না কেন, বেরোতেই হবে। সে ঝড়ই হোক, আর বৃষ্টিই হোক, আর বরফই পড়ুক।’
ফণীবাবু তাঁর পাওনা টাকা নিয়ে চলে গেলেন। রাজনবাবু এবার সোজা হয়ে উঠে বসে বললেন, ‘তোমরা আসাতে অনেকটা সুস্থ বোধ করছি। বেশ খানিকটা ঘাবড়ে গেস্লুম, জানো। এবার বোধহয় বৈঠকখানায় গিয়ে একটু বসা চলতে পারে।’
ফেলুদা আর তিনকড়িবাবু হাত ধরাধরি করে রাজেনবাবুকে বৈঠকখানায় এনে বসালেন।
তিনকড়িবাবু বললেন, ‘স্টেশনে ফোন করেছিলুম যদি যাওয়াটা দু দিন পেছোনো যায়। রহস্যের সমাধান না করে যেতে মন চাইছে না। কিন্তু ওরা বললে এ-টিকিট ক্যানসেল করলে দশ দিনের আগে বুকিং পাওয়া যাবে না।’
এটা শুনে আমার ভালই লাগল। আমি চাইছিলাম ফেলুদা একাই ডিটেক্টিভের কাজটা করুক। তিনকড়িবাবু যেন ফেলুদার অনেকটা কাজ আগে-আগেই করে দিচ্ছিলেন।
রাজেনবাবু বললেন, ‘আমার চাকরটার পাহারা দেবার কথা ছিল, কিন্তু আমি নিজেই কাল দশটার সময় তাকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি। ওর বাড়িতে খুব অসুখ। বুড়ো বাপ আছে, তার এখন-তখন অবস্থা।’
ফেলুদা বলল, ‘মাস্কটা কেমন ছিল মনে আছে?’
রাজেনবাবু বললেন, ‘খুবই সাধারণ নেপালি মুখোশ, দার্জিলিং শহরেই অন্তত আরও তিন-চার শ’ খোঁজ করলে পাওয়া যাবে। আমার এই ঘরেই তো আরও পাঁচখানা রয়েছে–ওই যে, দ্যাখো-না।’
রাজেনবাবু যে মুখোশটার দিকে আঙুল দেখালেন, ঠিক সেই জিনিসটা কাল ফেলুদা আমার জন্য কিনে দিয়েছে।
তিনকড়িবাবু এতক্ষণ বেশি কথা বলেননি, এবার বললেন, ‘আমার মনে হয় এবার বোধহয় পুলিশে একটা খবর দেওয়া উচিত। একটা প্রোটেক্শনেরও তো দরকার। কাল যা ঘটেছে, তার পরে তো আর ব্যাপারটাকে ঠাট্টা বলে নেওয়া চলে না। ফেলুবাবু, তুমি তোমার নিজের ইচ্ছে মত তদন্ত চালিয়ে যেতে পারো, তাতে তোমায় কেউ বাধা দেবে না। কিন্তু আমি সব দিক বিবেচনা করে বলছি, এবার পুলিশের সাহায্য নেওয়া দরকার। আমি বরং যাই, গিয়ে একটা ডায়েরি করে আসি। প্রাণের ভয় আছে বলে মনে হয় না, তবে রাজেনবাবু, আপনার ঘণ্টাটা একটু সাবধানে রাখবেন।’
আমরা যখন উঠছি, তখন ফেলুদা রাজেনবাবুকে বলল, ‘তিনকড়িবাবু তো চলে যাচ্ছেন। তার মানে আপনার একটি ঘর খালি হয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি আজ রাতটা ও ঘরে এসে থাকি, তা হলে আপনার কোনও আপত্তি আছে কি?’
রাজেনবাবু বললেন, ‘মোটেই না। আপত্তি কি? তুমি তো হলে আমার প্রায় আত্মীয়ের মতো। আর সত্যি বলতে কী, যতো বুড়ো হচ্ছি তত যেন সাহসটা কমে আসছে। ছেলেবয়সে দুরন্ত হলে নাকি বুড়ো বয়সে মানুষ ম্যাদা মেরে যায়।’
তিনকড়িবাবুকে ফেলুদা বলল স্টেশনে ওঁকে ‘সি-অফ’ করতে যাবে।
ফেরার পথে যখন নেপাল কিউরিও শপের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, তখন আমাদের দুজনেরই চোখ গেল দোকানের ভিতর।
দেখলাম দুজন ভদ্রলোক দোকানের ভিতর জিনিসপত্র দেখছে আর পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছে। দেখে মনে হয় দুজনের অনেক দিনের আলাপ।
একজন অবনী ঘোষাল, আর একজন প্রবীর মজুমদার।
আমি ফেলুদার দিকে চাইলাম। তার মুখের ভাব দেখে মনে হল না সে কোনও আশ্চর্য জিনিস দেখেছে। সাড়ে দশটার সময় স্টেশনে গেলাম তিনকড়িবাবুকে গুড বাই করতে। উনি এলেন আমাদেরও পাঁচ মিনিট পরে।
‘চড়াই উঠে উঠে পায়ে ব্যথা হয়ে গেছে তাই আস্তে হাঁটতে হল।’ সত্যিই ভদ্রলোক একটু খোঁড়াচ্ছিলেন। নীল রঙের ফার্স্ট ক্লাস কামরায় উঠে তিনকড়িবাবু তাঁর অ্যাটাচিকেস খুলে একটা ব্রাউন কাগজের প্যাকেট ফেলুদাকে দিলেন।
‘এটা কিনতেও একটু সময় লাগল। রাজেনবাবু তো আর কিউরিওর দোকানে যেতে পারলেন না, অথচ কাল সত্যিই অনেক ভাল জিনিস এসেছে। তার থেকে একটি সামান্য জিনিস বাছাই করে ওঁর জন্য এনেছি। তোমরা আমার নাম করে শুভেচ্ছা জানিয়ে ওঁকে দিয়ে দিও।
ফেলুদা প্যাকেটটা নিয়ে বলল, আপনার ঠিকানা দিয়ে গেলেন না? মিস্ট্রিটা সল্ভ করে আপনাকে জানিয়ে দেব ভাবছিলাম যে।’
তিনকড়িবাবু বললেন, ‘আমার প্রকাশকের ঠিকানাটা আমার বইতেই পাবে–তার কেয়ারে লিখলেই চিঠি আমার কাছে পৌঁছে যাবে। গুড লাক!’
ট্রেন ছেড়ে দিল। ফেলুদা আমাকে বলল, ‘লোকটা বিদেশে জন্মালে দারুন নাম আর পয়সা করত। পর পর এতগুলো ভাল রহস্য উপন্যাস খুব কম লোকেই লিখেছে।’
সারা দিন ধরে ফেলুদা রাজেনবাবুর ব্যাপারটা নিয়ে নানান জায়গায় ঘোরাফেরা করল। আমি অনেক করে বলতেও আমাকে সঙ্গে নিল না। সন্ধেবেলা যখন রাজেনবাবুর বাড়ি যাচ্ছি, তখন ফেলুদাকে বললাম, ‘কোথায় কোথায় গেলে সেইটে অন্তত বলবে তো!’
ফেলুদা বলল, ‘দুবার মাউণ্ট এভারেস্ট হোটেল, একবার ফণী মিত্তরের বাড়ি, একবার নেপাল কিউরিও শপ, একবার লাইব্রেরি, আর এছাড়াও আরও কয়েকটা জায়গা।’
‘ও।’
‘আর কিছু জানতে চাস?’
‘অপরাধী কে বুঝতে পেরেছ?’
‘এখনও বলার সময় আসেনি।’
‘কাউকে সন্দেহ করেছ?’
‘ভাল ডিটেক্টিভ হলে প্রত্যেককেই সন্দেহ করতে হয়।’
‘প্রত্যেককে মানে?’
‘এই ধর–তুই।’
‘আমি?’
‘যার কাছে এই মুখোশ আছে, সে-ই সন্দেহের পাত্র, সে যে-লোকই হোক।’
‘তা হলে তুমিই বা বাদ যাবে কেন?’
‘বেশি বাজে বকিস্নি।’
‘বা রে–তুমি যে রাজেনবাবুকে আগে চিনতে, সে কথা তো গোড়ায় বলোনি। তার মানে সত্য গোপন করেছ। আর আমার মুখোশ তো ইচ্ছে করলে তুমিও ব্যবহার করতে পারো–হাতের কাছেই থাকে।’
‘শাটাপ্, শাটাপ্!’
রাজেনবাবুকে এ বেলা দেখে তবু অনেকটা ভাল লাগল। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতে বললেন, ‘দুপুরের দিকটা বেশ ভাল বোধ করছিলাম। যত সন্ধে হয়ে আসছে ততই যেন কেমন অস্বস্তি লাগছে।’ ফেলুদা তিনকড়িবাবুর দেওয়া প্যাকেটটা রাজনবাবুকে দিল। সেটা খুলে তার থেকে একটা চমৎকার বুদ্ধের মাথা বের হল। সেটা দেখে রাজনবাবুর চোখ ছলছল করে এল। ধরা গলায় বললেন, ‘খাশা জিনিস, খাশা জিনিস!’
ফেলুদা বলল, ‘পুলিশ থেকে লোক এসেছিল?’
‘আর বলো না। এসে বত্রিশ রকম জেরা করলে। কদ্দুর কী হদিশ পাবে জানি না, তবে আজ থেকে বাড়িটা ওয়াচ করার জন্য লোক থাকবে, সেই যা নিশ্চিন্তি। সত্যি বলতে কী, তোমরা হয়তো না এলেও চলল।’
ফেলুদা বলল, ‘স্যানাটোরিয়ামে বড্ড গোলমাল। এখানে হয়তো চুপচাপ আপনার কেসটা নিয়ে একটু ভাবতে পারব।’
রাজেনবাবু হেসে বললেন, ‘আর তা ছাড়া আমার চাকরটা খুব ভাল রান্না করে। আজ মুরগির মাংস রাঁধতে বলেছি। স্যানাটোরিয়ামে অমনটি খেতে পাবে না।’
রাজেনবাবু আমাদের ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। ফেলুদা সটান খাটের উপর শুয়ে পড়ে একটা সিগারেট ধরিয়া কড়িকাঠের দিকে তাগ করে পর পর পাঁচটা ধোঁয়ার রিং ছাড়ল। তারপর আধবোজা চোখে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘ফণী মিত্তির কাল সত্যিই রুগি দেখতে গিয়েছিলেন। কার্ট রোডে একজন ধনী পাঞ্জাবি ব্যবসায়ির বাড়ি। আমি খোঁজ নিয়েছি। সাড়ে এগারোটা থেকে সাড়ে বারোটা অবধি ওখানে ছিলেন।’
‘তা হলে ফণী মিত্তির অপরাধী নন?’
ফেলুদা আমার কথার জবাব না দিয়ে বলল, ‘প্রবীর মজুমদার ষোলো বছর ইংলণ্ডে থেকে বাংলা প্রায় ভুলেই গেছেন।’
‘তা হলে ওই চিঠি ওর পক্ষে লেখা সম্ভব নয়?’
‘আর ওর টাকার কোনও অভাবই নেই। তা ছাড়া দার্জিলিং-এ এসেও লেবং-এ ঘোড়দৌড়ের বাজিতে উনি অনেক টাকা করেছেন।’
আমি দম আটকে বসে রইলাম। ফেলুদার আরো কিছু বলার আছে সেটা বুঝতে পারছিলাম। আধখাওয়া সিগারেটটা ক্যারমের ঘুঁটি মারার মতো করে প্রায় দশ হাত দূরের জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে ফেলুদা বলল, ‘আজ চা বাগানের গিলমোর সাহেব দার্জিলিং-এ এসেছে। প্লান্টারস ক্লাবে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। লামার প্রাসাদের আসল ঘণ্টা একটাই আছে, আর সেটা গিলমারের কাছে। রাজনবাবুরটা নকল। অবনী ঘোষাল সেটা জানে।’
‘তা হলে রাজেনবাবুর ঘণ্টা তেমন মূল্যবান নয়?’
‘না।…আর অবনী ঘোষাল কাল রাত্রে একটা পার্টিতে প্রবীর মজুমদারের সঙ্গে রাত ন’টা থেকে ভোর তিনটে অবধি মাতলামি করেছে।’
‘ও। আর মুখোশ পরা লোকটা এসেছিল বারোটার কিছু পরেই।’
‘হ্যাঁ।’
আমার বুকের ভেতরটা কেমন খালি খালি লাগছিল। বললাম, ‘তা হলে?’
ফেলুদা কিছু না বলে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে খাট থেকে উঠে পড়ল। ওর ভুরু দুটো যে এতটা কুঁচকোতে পারে, তা আমার জানাই ছিল না। কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে কী যেন ভেবে ফেলুদা বৈঠকখানার দিকে চলে গেল। যাবার সময় বলল, ‘একটু একা থাকতে চাই। ডিস্টার্ব করিস না।’
কী আর করি। এবার ওর জায়গায় আমি বিছানায় শুলাম। সন্ধে হয়ে আসছে। ঘরের বাতিটা আর জ্বালতে ইচ্ছে করল না। খোলা জানলা দিয়ে অবজারভেটরি হিলের দিকটায় অন্যান্য বাড়ির আলো দেখতে পাচ্ছিলাম। বিকেলে ম্যাল থেকে একটা গোলমালের শব্দ পাওয়া যায়। এখন সেটা মিলিয়ে আসছে। একটা ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পেলাম। দূর থেকে কাছ এসে আবার মিলিয়ে গেল। সময় চলে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে শহরের আলো কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসছে। বোধহয় কুয়াশা হচ্ছে। ঘরের ভিতরটা এখন আরও অন্ধকার। একটা ঘুম-ঘুম ভাব আসছে মনে হল।
চোখের পাতা দুটো কাছাকাছি এসে গেছে, এমন সময় মনে হল, কে যেন ঘরে ঢুকছে। মনে হতেই এমন ভয় হল যে, যে দিক থেকে লোকটা আসছে, সে দিকে না তাকিয়ে আমি জোর করে নিশ্বাস বন্ধ করে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু লোকটা যে আমার দিকেই আসছে আর আমার সামনেই এসে দাঁড়াল যে! জানালার বাইরে শহরের দৃশ্যটা ঢেকে দিয়ে একটা অন্ধকার কী যেন এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছে।
তার পর সেই অন্ধকার জিনিসটা নিচু হয়ে আমার দিকে এগিয়ে এল। এইবার তার মুখটা আমার মুখের সামনে, আর সেই মুখে একটা–মুখোশ! আমি যেই চিৎকার করতে যাব অমনি অন্ধকার শরীরটার একটা হাত উঠে গিয়ে মুখোশটা খুলতেই দেখি–ফেলুদা!
‘কী রে–ঘুমিয়ে পড়েছিলি নাই?’
‘ওঃ–ফেলুদা–তুমি?’
‘তা আমি না তো কে? তুই কি ভেবেছিলি…?’
ফেলুদা ব্যাপারটা বুঝে একটা অট্টহাসি করতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গম্ভীর হয়ে গেল। তার পর খাটের পাশটায় বসে বলল, ‘রাজেনবাবুর মুখোশগুলো সব কটা পরে দেখছিলাম। তুই এইটে একবার পর তো।’
ফেলুদা আমাকে মুখোশটা পরিয়ে দিল।
‘অস্বাভাবিক কিছু লাগছে কি?’
‘কই না তো। আমার পক্ষে একটু বড়, এই যা।’
‘আর কিচ্ছু না?’ ভাল করে ভেবে দেখ তো।’
‘একটু…একটু যেন…গন্ধ।’
‘কীসের গন্ধ?’
‘চুরুট।’
ফেলুদা মুখোশটা খুলে নিয়ে বলল, ‘এগজ্যাক্টলি।’
আমার বুকের ভিতরটা আবার টিপ টিপ করছিল। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, তি-তিনকড়িবাবু?’
ফেলুদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘সুযোগের দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি ছিল এঁরই। বাংলা উপন্যাস, খবরের কাগজ, ব্লেড, আঠা কোনওটারই অভাব নেই। আর তুই লক্ষ করেছিলি নিশ্চয়ই–স্টেশনে আজ যেন একটু খোঁড়াচ্ছিলেন। সেটা বোধহয় কাল জানালার বাহিরে লাফিয়ে পড়ার দরুন। কিন্তু আসল যেটা রহস্য, সেটা হল–কারণটা কী? রাজেনবাবুকে তো মনে হয় রীতিমতো সমীহ করতেন ভদ্রলোক। তা হলে কী কারণে, কী উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি এই চিঠি লিখেছিলেন? এটার উত্তর বোধ হয় আর জানা যাবে না…কোনও দিনও না।’
**********
রাত্রে কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। সকালে খাবার ঘরে বসে রাজেনবাবুর সঙ্গে চা খাচ্ছি, এমন সময় নেপালি চাকরটা একটা চিঠি নিয়ে এল। আবার সেই নীল কাগজ–আর খামের উপর দার্জিলিং পোস্ট মার্ক। রাজেনবাবু ফ্যাকাশে মুখ করে কাঁপতে কাঁপতে চিঠির ভাজ খুলে ফেলুদাকে দিয়ে বললেন, ‘তুমিই পড়ো। আমার সাহস হচ্ছে না।’
ফেলুদা চিঠিটা নিয়ে জোরে জোরে পড়ল। তাতে লেখা আছে–
‘প্রিয় রাজু, কলকাতায় জ্ঞানেশের কাছ থেকে তোমার খবর পেয়ে যখন তোমায় চিঠি লিখি, তখনও জানতাম না আসলে তুমি কে। তোমার বাড়িতে এসে তোমার ছেলেবয়সের ছবিখানা দেখেই চিনেছি, তুমি সেই পঞ্চাশ বছর আগের বাঁকুড়া মিশনারি স্কুলের আমারই সহপাঠী রাজু!
‘এতকাল পরেও যে পুরনো আক্রোশ চাগিয়ে উঠতে পারে, সেটা আমার জানা ছিল না। অন্যায়ভাবে ল্যাং মেরে তুমি যে শুধু আমার হাণ্ড্রেড ইয়ার্ডস-এর নিশ্চিত পুরস্কার ও রেকর্ড থেকে বঞ্চিত করেছিলে, তাই নয়–আমাকে রীতিমত জখমও করেছিলে। বাবা বদলি হলেন তখনই, তাই তোমার সঙ্গে বোঝাপড়াও হয়নি, আর তুমিও আমার মন আর শরীরের কষ্টের কথা জানতে পারোনি। তিনি মাস পায়ে প্লাস্টার লাগিয়ে হাসপাতালে পড়ে ছিলাম।
‘এখানে এসে তোমার জীবনের শান্তিময় পরিপূর্ণতার ছবি আমাকে অশান্ত করেছিল। তাই তোমার মনে খানিকটা সাময়িক উদ্বেগের সঞ্চার করে তোমার সেই প্রাচীন অপরাধের শাস্তি দিলাম। শুভেচ্ছা নিও।
ইতি–তিনু (শ্রীতিনকড়ি মুখোপাধ্যায়)।