পার্বতীবাবুকে মাথার উপরের একটা ভারী জিনিস দিয়ে আঘাত মেরে খুন করা হয়েছে। এঁদের বাড়ির ডাক্তার সৌরীন সোম বললেন, মৃত্যুটা হয়েছে মারার সঙ্গে সঙ্গেই। ভদ্রলোকের রক্তের চাপ ওঠা-নামা করত, হার্টেরও গোলমাল ছিল।
ইতিমধ্যে পুলিশও এসে গেছে। ইন্সপেক্টর হাজরা ফেলুদাকে চেনেন। মোটামুটি খাতিরও করেন। সাধারণ পুলিশের লোক প্রাইভেট ইনভেসটিগেটরকে যে রকম অবজ্ঞার চোখে দেখে, সে রকম নয়। বললেন, আমাদের যা রুটিন কাজ তা করে যাচ্ছি। আমরা, যদি কিছু তথ্য বেরোয় তো আপনাকে জানাব।
ফেলুদা বলল, যে ভারী জিনিসটা দিয়ে খুন করা হয়েছিল সেটা সম্বন্ধে কোনও আইডিয়া করেছেন?
হাজরা বললেন, তেমন তো কিছু দেখছি না। আশেপাশে। খুনি সেই জিনিসটা নিয়েই ভৌগেছে বলে মনে হচ্ছে।
পেপারওয়েট।
পেপারাওয়েট?
একবার আসুন আমার সঙ্গে।
হাজরা ও ফেলুদার পিছন পিছন আমরাও ঢুকলাম ঘরের মধ্যে।
ফেলুদা টেবিলের একটা অংশে আঙুল দিয়ে দেখাল।
সবুজ ফেল্টের উপর মিহি ধুলো জমে আছে। তারই একটা অংশে একটা ধুলোহীন গোল চাকতি। খুব ভাল করে লক্ষ না করলে বোঝা যায় না।
অমিতাভবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলল ফেলুদা, একটা বেশ বড় এবং ভারী ভিক্টোরীয় আমলের কাচের পেপারওয়েট থাকত এই টেবিলের উপর। এখন নেই।
ওয়েল ডান, মিস্টার মিত্তির!
কিন্তু আসল লোক তো বেমালুম হাওয়া হয়ে গেল বলে মনে হচ্ছে, ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল ফেলুদা।
হাজরা বললেন, নাম আর ডেসক্রিপশন যখন পাওয়া গেছে, তখন তাকে খুঁজে বের করতে অসুবিধা হবে না। তা ছাড়া সে তো অ্যাপ্লিকেশন করেছিল; সেটা থেকে থাকলে তো তার ঠিকানাই পাওয়া যাবে। আমার মনে হয়। দারোয়ান সত্যি কথা বলছে না। একটা সময় সে গেটের কাছে ছিল না; তখনই লোকটা পালিয়েছে। মেন ক্লোভের উপর বাড়ি, হয়তো বেরিয়েই বাস পেয়ে গেছে! অবিশ্যি সে ছাড়াও তো আরও লোক এসেছিল। সকালে। সাধনবাবু আসার ঠিক আগেই আরেকজন ভদ্রলোক এসেছিলেন। খুনটা তিনিও করে থাকতে পারেন।
কিন্তু পার্বতীবাবুকে মৃত দেখলে সাধনবাবু আর থাকবেন কেন?
আপনি তো দেখেছেন ঘরটা; ও তো কিউরিওর দোকান মশাই; একজন লোক যদি অসৎ হয়, ও ঘরে ঢুকে মালিক মৃত দেখলে তো তার পোয়া বারো!
আপনি দেখলে বুঝতে পারবেন কোনও জিনিস গেছে কি না?
ফেলুদা প্রশ্নটি করল। বর্তমান সেক্রেটারি হৃষীকেশ দত্তকে। ভদ্রলোক দশটার ঠিক আগে বেরিয়েছিলেন পোস্ট আপিসে দুটো জরুরি বিদেশি টেলিগ্রাম করতে। ফেরার পরেই আমাদের সঙ্গে সিঁড়িতে দেখা হয়।
তা হয়তে পারতে পারি, বললেন হৃষীকেশবাবু। বাইরের যা জিনিস তা মোটামুটি সবই আমার জানা। ভিতরে আলমারিবন্দি জিনিসেরও একটা তালিকা একবার আমাকে দিয়ে করিয়েছিলেন মিঃ হালদার। তার কিছু জিনিস বোধহয় আজ পেস্টনজীকে দেখাবার জন্য বার করেছিলেন। পেস্টনজী আসেন সাড়ে নটায়।
এই পেস্টনজীর সঙ্গে কি আগেই আলাপ ছিল পার্বতীবাবুর?
খুব। প্রায় দশ বছরের আলাপ। মাসে অন্তত দুবার করে আসতেন। উনিও একজন কালেক্টর। মিঃ হালদারের সংগ্রহে একটা চিঠি ছিল, সেটা দেখতেই ভদ্রলোক আসেন।
এটা কি সেই নেপোলিয়নের চিঠি?
হ্যাঁ।
সেটা কি মিঃ হালদার বিক্রি করার কথা ভাবছিলেন?
মোটেই না। পেস্টনজীর খুব লোভ ছিল ওটার উপর। তিনি মোটা টাকা অফার করবেন, আর মিঃ হালদার রিফিউজ করবেন—তাতে পেস্টনজীর মুখের ভাবটা কেমন হবে সেটা দেখেই মিঃ হালদারের আনন্দ। এ ব্যাপারে ওঁর একটা জিদও ছিল। এই চিঠিটা কেনার জন্য একবার এক আমেরিকান দাম চড়াতে চড়াতে বিশ হাজার ডলারে উঠেছিল। মিঃ হালদার ক্রমাগত মাথা নেড়ে গেলেন। সাহেবের মুখ লাল, শেষ পর্যন্ত মুখ খারাপ করতে আরম্ভ করল, আর সমস্ত ব্যাপারটা বসে বসে উপভোগ করলেন মিঃ হালদার। আজও পেস্টনজী গলা চড়াতে শুরু করেছিলেন সেটা আমি বাইরে থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম।
কীসের মধ্যে থাকত জিনিসটা?
একটা অ্যালক্যাথিনের খামে।
তা হলে বোধ হয় যায়নি চিঠিটা। কারণ খামটা টেবিলের উপরই রয়েছে। আর তার মধ্যে একটা সাদা ভাঁজ করা কাগজও দেখলাম।
না গেলেই ভাল। ও চিঠির মর্ম সকলে বুঝবে না।
চুরি হয়েছে কি না সেটা এখন জানা যাবে না, কারণ পুলিশ ও ঘরে কাজ করছে; তা ছাড়া পুলিশের ডাক্তার এইমাত্র এসেছেন, তিনি লাশ পরীক্ষা করছেন।
হৃষীকেশবাবু বললেন, আশ্চর্য। যে সময় সাধনবাবু গেলেন, প্রায় সে সময়ই আমি ফিরেছি। অথচ লোকটার সঙ্গে দেখা হল না।
আপনি বেরিয়েছেন কটায়? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
ঠিক দশটা বাজতে পাঁচ। এখান থেকে পাঁচ মিনিট লাগে পোস্টাপিস যেতে। খোলার সঙ্গে সঙ্গে টেলিগ্রামগুলো দিতে চেয়েছিলাম।
সে তো পাঁচ মিনিটের কাজ, তা হলে ফিরতে এত দেরি হল কেন?
হৃষীকেশবাবু মাথা নাড়ালেন। —আর বলবেন না মশাই। ঘড়ির ব্যান্ডের খোঁজ করছিলুম স্টেশনারি দোকানগুলোতে। দেখছেন না ডান হাতে ঘড়ি পরেছি। ব্যান্ডটা ঢিলে হয়ে গেছে। বাঁ কবজি আমার ডান কবজির চেয়ে প্রায় আধা ইঞ্চি সরু। ব্যান্ড ঢলঢল করে। কোনও লাভ হল না। সেই নিউ মার্কেট ছাড়া গতি নেই।
ভদ্রলোক ডান হাতে ঘড়ি পরেন সেটা আগেই লক্ষ করেছি।
আপনি এ বাড়িতেই থাকেন? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল। অমিতাভবাবু ভিতরে সামলাচ্ছেন, তা ছাড়া উনি নিজেও বেশ ভেঙে পড়েছেন, তাই ফেলুদা হৃষীকেশবাবুর কাছ থেকে যা তথ্য পাওয়া যায় বার করে নিচ্ছে।
হ্যাঁ, এ বাড়িতেই, বললেন হৃষীকেশবাবু, একতলায়। ফ্যামিলি-ট্যামিলি নেই, তাই মিঃ হালদার বললেন। এখানেই থাকতে; ঘরের তো অভাব নেই। সাধনবাবুও শুনেছি। এ বাড়িতেই থাকতেন।
এ কাজ তো ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন। আপনি। ভাল লাগছিল না বুঝি?
প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছিল মশাই। তা ছাড়া উন্নতির সুযোগ আজকের দিনে কে ছাড়ে বলুন। মিঃ হালদার অবিশ্যি এমপ্লয়ার হিসেবে ভালই ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে কিছু বলার নেই আমার।
আর একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে এর মধ্যে আলাপ হয়েছে, যদিও কথা হয়নি। তিনি হলেন অমিতাভবাবুর ছোট ভাই অচিন্ত্যবাবু। ভদ্রলোক বাড়িতেই ছিলেন, তাই বোধ হয় পুলিশ এখন তাঁকে জেরা করছে। ফেলুদা হৃষীকেশবাবুকেই জিজ্ঞেস করলেন ছোট ভাইয়ের কথা।
অচিন্ত্যবাবু কী করেন?
থিয়েটার।
থিয়েটার?
আমরা তিনজনেই অবাক।
পেশাদারি থিয়েটার? মানে থিয়েটার করেই ওঁর রোজগার?
হৃষীকেশবাবুকে উত্তরটা দিতে যেন বেশ একটু ভাবতে হল। বললেন, এ সব ভেতরের ব্যাপার। আর সত্যি, আমার পক্ষে বলাটা বোধ হয় খুব শোভা পায় না। এ ফ্যামিলিতে থিয়েটার করাটা বেমানান তাতে সন্দেহ নেই, তবে আমার একটা সন্দেহ হয়েছে যে অচিন্তবাবুর মনে একটা বড় রকমের অভিমান ছিল। চার ভাইয়ের মধ্যে উনিই একমাত্র বিলেত যাননি পড়াশুনো করতে। আসলে বড় ফ্যামিলিতে ছোট ভাই অনেক সময় একটু নেগালেকটেড হয়। ওনার ক্ষেত্রে মনে হয় সেটাই হয়েছে। আমার সঙ্গে মাঝে-মধ্যে কথাবার্তা থেকেও সেটাই মনে হয়েছে। চাকরি একটা করিয়ে দিয়েছিলেন মিঃ হালদারাই, কিন্তু অচিন্তবাবু সেটা ছেড়ে দেন। থিয়েটারের শখটা বোধ হয় এমনিতেই ছিল। বারাসতে একটা ড্রামাটিক ক্লাব নিয়ে খুব মেতে ওঠেন, কিন্তু তাতে মন ভরে না। এখন নবরঙ্গমঞ্চে ঘোরাঘুরি করছেন। দু-একটা হিরোর পার্টও নাকি করেছেন। কালিও দেখছিলাম পার্ট মুখস্থ করেছেন।
এবারে ইনস্পেক্টর হাজরা এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। অচিন্ত্যবাবুর জেরা শেষ। তিনি গোমড়া মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। হাজরা বললেন, খুনটা হয়েছে দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে। পেস্টনজী ছিলেন সাড়ে নটা থেকে দশটার কিছু পর অবধি। সাধন দস্তিদার এসেছেন সেয়া দশটায়, গেছেন সাড়ে দশটায়। ছোট ছেলের ঘর থেকে বাইরের ঝরান্দা দিয়ে সোজা বাপের ঘরে যাওয়া যায়। বাড়ির ভেতরের লোক দেখতে পাবে না। দশটা পাঁচ থেকে সোয়া দশটার মধ্যে অচিন্ত্যবাবু বাপের ঘরে এসে থাকতে পারেন। উনি বলছেন। সারা সকাল পার্ট মুখস্থ করেছেন, কেবল সাড়ে দশটা নাগাদ একবার ভাইপো অনিরুদ্ধর ডাক পেয়ে তার কাছে যান। তার খেলার মেশিনগানটা দেখতে। তখনও তিনি বাপের মৃত্যু-সংবাদ পাননি। যাই হাক, মোটামুটি তিন জনেরই মোটিভ ছিল। ছেলের সঙ্গে বাপের বনত না, পেস্টনজী ছিলেন মিঃ হালদারের রাইভ্যাল, আর সাধন দস্তিদারের ছিল পুরনো আক্ৰোশ। এই হল ব্যাপার। এবার আপনি এসে একটু দেখে বলুন তো কিছু চুরি গেছে কি না।
শেষ অনুরোধটা করা হল হৃষীকেশবাবুকে। ভদ্রলোক এগিয়ে গেলেন স্টাডির দিকে, আমরা তাঁর পিছনে।
ঘরটায় ঢুকে স্বামীকেশবাবু একবার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন। মেক্যানিক্যাল জিনিসে পাৰ্বতীবাবুর খুব শখ ছিল, কারণ বৈঠকখানায় দেখেছি। একটা প্রথম যুগের সিলিন্ডার গ্রামোফোন, আর এ ঘরে দেখছি একটা আদ্যিকালের ম্যাজিক ল্যানটার্ন। তা ছাড়া ছোট ছোট মূর্তি, পাত্র, দোয়াত, কলম, পিস্তল, পুরনো ছবি, ম্যাপ, বই-এ সব তো আছেই। বাইরের জিনিসপত্র দেখে, চাবি দিয়ে আলমারি, বাক্স দেরাজ ইত্যাদি খুলে দেখে অবশেষে হৃষীকেশবাবু জানালেন যে কোনও জিনিস গেছে বলে তো মনে হচ্ছে না।
ফেলুদা বলল, আপনি অ্যালক্যাথিনের খামটা একবার দেখলেন না?
ওতে তো চিঠিটা রয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।
তবু একবার দেখে নেওয়া উচিত।
হৃষীকেশবাবুকে খামটা খুলে ভেতরের কাগজটা টেনে বার করতে হল। কাগজের রংটা দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল; পুরনো কাগজ কি এত সাদা হয়? ভাঁজ করা কাগজটা খুলে ফেলেই ভদ্রলোক চেঁচিয়ে উঠলেন।
এ কী! এঃ তো প্যাড থেকে ছেঁড়া হালদার মশাইয়ের নিজের চিঠির কাগজ।
অর্থাৎ নেপোলিয়নের চিঠি উধাও।
আরও আধা ঘণ্টা ছিলাম আমরা হালদারবাড়িতে। সেই সময়টা ফেলুদা বাড়ির কম্পাউন্ডটা ঘুরে দেখল। বাগানটা দেখা শেষ করে, কম্পাউন্ড ওয়ালের কোনও অংশ নিচু বা ভাঙা আছে কি না দেখে আমরা পুকুরের কাছে এলাম! ফেলুদার দৃষ্টি মাটির দিকে, জানি ও পায়ের ছাপ খুঁজছে। শুকনো মাটি, পায়ের ছাপের সম্ভাবনা কম, তবে পুকুরের পূর্ব পাড়ে একটা অংশ ফেলুদার দৃষ্টি আকর্ষণ করায় সে থেমে গেল!
একটা ছোট্ট বুনো ফুলের গাছ যেন কীসের চাপে পিষে গেছে। আর সেটা হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই।
ফেলুদা ফুলের আশপাশটা দেখে পুকুরের দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এ পুকুর ব্যবহার হয় না, তাই জলটা পানার আবরণে ঢেকে গেছে। আমরা যেখানটা দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে হাত পাঁচেক দূরে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে পান সরে গিয়ে জল বেরিয়ে পড়েছে।
কিছু ফেলা হয়েছে কি জলের মধ্যে? তাই তো মনে হয়।
কিন্তু ফেলুদা এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করল না। যা দেখবার ও দেখে নিয়েছে।
বাড়ি ফেরার সময় লালমোহনবাবু হঠাৎ বললেন, বাগানে একটা চন্দনা দেখলুম বলে মনে হল। একটা পেয়ারা গাছ থেকে উড়ে একটা সজনে গাছে গিয়ে বসল।
সেটা আমাদের বললেন না কেন? ধমকের সুরে বলল ফেলুদা।
কী জানি, যদি বেরিয়ে যায়। টিয়া! দুটো পাখি এত কাছাকাছি। তবে এ পাখিটা কথা বলে।
আপনি শুনলেন কথা?
শুনলুম বইকী। আপনারা তখন বাগানের উলটা দিকে; আমি আরেকটু হলেই একটা তেঁতুলে বিছের উপর পা ফেলেছি, এমন সময় শুনলুম, বাবু, সাবধান। আর মুখ তুলে দেখি পাখি।
পাখি বলল বাবু সাবধান?
তাই তো স্পষ্ট শুনলুম। আপনারা বিশ্বাস করবেন না বলেই বলিনি।
বিশ্বাস করাটা সত্যিই কঠিন, তাই কথা আর এগোল না।
তবে এটা ঠিক যে এ রকম একটা খুন। আর এ রকম চুরির পরেও ফেলুদার মন থেকে চন্দনার ব্যাপারটা যাচ্ছে না। খুনের দু দিন পর, সোমবার সকালে চা খাওয়ার পর ফেলুদার কথায় সেটা বুঝতে পারলাম, ও বলল, পার্বতীবাবুর খুন। আর নেপোলিয়নের চিঠি চুরি—এই দুটো ঘটনাই গতানুগতিক। কিন্তু আমাকে একেবারে বোকা বানিয়ে দিয়েছে এই পাখি চুরির ব্যাপারটা।
গতকাল অমিতাভ বাবু ফোন করেছিলেন; ফেলুদা জানিয়ে দিয়েছে যে নেহাত দরকার না। পড়লে এই অবস্থায় ও আর ওঁদের বিরক্ত করবে না, বিশেষ করে পুলিশ যখন তদন্ত চালাচ্ছেই। লালমোহনবাবু বলেছেন সোমবার হলেও আজ একবার আসবেন, কারণ কী ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে না হচ্ছে সেটা জানার ওঁর বিশেষ আগ্ৰহ।
আমি বললাম,পাখির খাঁচার গায়ে রক্তটা পাখির না মানুষের সেটা তো এখনও জানা গেল না।
ওটা যে মানুষের, সেটা অ্যানালিসিস না করেই বলা যায়, বলল ফেলুদা।কেউ যদি পাখিকে খাঁচা থেকে বার করতে যায় তা হলে সেটা সাবধানেই করবে, কিন্তু পাখি ছটফট করতে পারে, খামচাতে পারে, ঠোকুরাতে পারে। অর্থাৎ যে লোকে পাখিটাকে কার করেছে, তার হাতে জখমের চিহ্ন থাকা উচিত।
সে জিনিস ও বাড়ির কারুর হাতে দেখলে?
উঁহু। সেটার দিকে আমি চোখ রেখেছিলাম। বাবু, চাকর কারুর হাতেই দেখিনি। অথচ টাটুকা জখম। অমিতাভবাবু বললেন পার্ক স্ট্রিটে আমাদের সঙ্গে দেখা হবার দু দিন আগে পাখিটা কিনেছিলেন। তার মানে ১৩ ডিসেম্বর। খুনটা হয় ১৯ ডিসেম্বর।..এই পাখির জন্য আমি অন্য ব্যাপারগুলোতে পুরোপুরি মনও দিতে পারছি না।
খুনের সুযোগ কার কার ছিল তার একটা লিস্ট করছিলে না তুমি কাল রাত্তিরে?
শুধু সুযোগ নয়, মোটিভও।
ফেলুদার পাশেই সোফায় পড়েছিল খাতাটা। সে ওটা খুলে বলল, সাধন দস্তিদার সম্বন্ধে নতুন কথা বলার বিশেষ কিছু নেই। রহস্যটা হচ্ছে তার অন্তধানে। এটা সম্ভব হয় একমাত্র যদি দারোয়ান মিথ্যে কথা বলে থাকে। সাধন তাকে ভালরকম ঘুষ দিয়ে থাকলে এটা হতে পারে। সেটা পুলিশে বার করুক। মিথ্যেবাদীকে সত্যি বালানোর রাস্তা তাদের জানা আছে।
দ্বিতীয় সাসপেক্ট–পেস্টনজী। তবে পেস্টনজীর সত্তর বছর বয়স; বুড়ো মানুষের পক্ষে এ খুন সম্ভব কি না সেটা ভাবতে হবে। আঘাতটা করা হয়েছিল রীতিমতো জোরে। অবিশ্যি সত্তরেও অনেকের স্বাস্থ্য দিব্যি ভাল থাকে। সেটা ভদ্রলোককে চাক্ষুষ না দেখা পর্যন্ত বোঝা যাবে না।
তৃতীয়-অচিন্ত হালদার। বাপের উপর ছেলের টান না থাকলেও খুন করার মতো আক্রোশ ছিল কি না সেটা ভাবার কথা। তবে নেপোলিয়নের চিঠি হাতাতে পারলে ওর আর্থিক সমস্যা কিছুটা মিটত ঠিকই। আর কেউ না হাক, পেস্টনজী যে সে চিঠি কিনতে রাজি হতেন, সেটা বোধহয় অনুমান করা যায়। চতুর্থ-
আবার আরও একজন আছে নাকি?
তাকে সাসপেক্ট বলে বলছি না, কিন্তু অমিতাভবাবু সে সময়টা কী করছিলেন, সেটা জানা দরকার বইকী। তাঁর জবানিতে তিনি বলেছেন সকালে তিনি বাগানে থাকেন। ওঁর খুব ফুলের শখ। সে দিন দশটা পর্যন্ত তিনি বাগানে ছিলেন। মাঝে একবার আমাদের ফোন করতে ন’ট্যার সময় তাঁকে নীচের বৈঠকখানায় আসতে হয়, তারপর আমরা আসার আগে আর দোতলায় যাননি। চাকর তাঁকে চা দিয়ে যায় দশটার সময় একতলায় বাগানের দিকের খোলা বারান্দায়। আমাদের গাড়ির আওয়াজ পেয়ে তিনি সামনের দিকে চলে আসেন। দোতলায় যান। তিনি একেবারে আমাদের নিয়ে, তার আগে নয়।
সব শেষে হলেন হৃষীকেশবাবু। ইনি দশটা বাজতে পাঁচে বেরিয়েছেন সেটা দারোয়ান দেখেছে, কিন্তু ফিরতে দেখেছে কি না মনে করতে পারছে না। দারোয়ানের কথাবার্তা খুব রিলায়েবল বলে মনে হয় না। চল্লিশ বছর চাকরি করছে বটে হালদার বাড়িতে, হয়তো এমনিতে বিশ্বস্ত, কিন্তু বয়স হয়েছে সত্তরের উপর, কাজেই স্মরণশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসা অস্বাভাবিক নয়। হৃষীকেশবাবু স্টেশনারি দোকানে অতটা সময় কাটিয়েছেন কি না সেটা জানা দরকার। যদি সে ব্যাপারে মিথ্যেও বলে থাকেন, তার খুনের সুযোগ সম্বন্ধে সন্দেহ থেকেই যায়। একমাত্র নেপোলিয়নের চিঠি হাত করা ছাড়া মোটিভও খুঁজে পাওয়া যায় না।
ফেলুদা খাতাটা বন্ধ করল। আমি বললাম, চাকর-বকিরদের বোধহয় সব কটাকেই বাদ দেওয়া যায়।
শুনিলিই তো চাকর সব কটাই পুরনো। তাদের মধ্যে বেয়ারা মুকুন্দ পাৰ্বতীচরণের ঘরে কফি নিয়ে যায় পেস্টনজী ও পার্বতীবাবুর জন্য। পার্বতীচরণ একা থাকলেও রোজ দশটায় কফি খেতেন। এ ছাড়া আর কোনও চাকর নটার পর পাৰ্ব্বতীচরণের ঘরে যায়নি। বাড়িতে লোক বলতে আর আছে অমিতাভবাবুর স্ত্রী, অনিরুদ্ধ, পার্বতীবাবুর আশি বছরের বুড়ি মা, মালী, মালীর এক ছেলে, ড্রাইভার ও দারোয়ান; অচিন্ত্যবাবু বিয়ে করেননি।
ফেলুদা একটা চারমিনার ধরাবার সঙ্গে সঙ্গেই ফোন বেজে উঠল। ইনস্পেক্টর হাজরা।
কী খবর বলুন স্যার, বলল ফেলুদা।
সাধন দস্তিদারের ঠিকানা পাওয়া গেছে।
ভেতি গুড।
ভেরি ব্যাড, কারণ সে ঠিকানায় ওই নামে কেউ থাকে না।
বটে?
এবং কোনও দিন ছিল ও না।
তা হলে?
তা হলে আর কী–যে তিমিরে সেই তিমিরে। মহা ফিচেল লোক বলে মনে হচ্ছে।
আর হৃষীকেশবাবুর অ্যালিবাই ঠিক আছে?
উনি পোস্টাপিসে গিয়েছিলেন। দশটায় এবং টেলিগ্রামগুলো করেছেন এটা ঠিক। তারপর স্টেশনারি দোকানো যাবার কথা যেটা বললেন, সেটা ভেরিফাই করা গেল না, কারণ দোকানে কেউ মনে করতে পারল না।
আর পেস্টনজী?
অসম্ভব তিরিক্ষি মেজাজের লোক। প্ৰচণ্ড ধনী। দেড়শো বছর কলকাতায় আছে। এই পাশি ফ্যামিলি। এমনিতে বেশ শক্ত সমর্থ লোক, তবে কাবু হয়ে আছেন আরগ্রাইটিসে, ডান হাত কাঁধের উপর ওঠে না! ওঁর পক্ষে এই খুন প্রায় ইমপসিবল। লর্ড সিনহা রোডে গিয়ে রোজ সকালে ফিজিওথেরাপি করান। চেক করে দেখেছি; কথাটা সত্যি।
তা হলে তো সাধন দস্তিদারের সন্ধানেই লেগে থাকতে হয়।
আমার ধারণা লোকটা বারাসতেই থাকে, কারণ ওর অ্যাপ্লিকেশনের খামে বারাসতের পোস্টমার্ক রয়েছে।
সে কী, এ তো খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার।
আমরা খোঁজ করছি। এখানে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারবে বলে মনে হয় না। ও, ভাল কথা, খোকার ঘরে চোর এসেছিল।
আবার?
আবার মানে?
হাজরা পাখির কথাটা জানেন না। ফেলুদা সেটা চেপে গিয়ে বলল, না, বলছিলাম-একটা চুরি তো হল বাড়িতে, আবার চোর?
যাই হাক, কিছু নেয়নি।
খোকা টের পেলে কী করে?
সে বাবা-মায়ের পাশের ঘরে এক শোয়। বিলিতি কায়দা আর কী। তা কাল মাঝ রাত্তিরে নাকি খুঁটিখাট শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। ছেলের সাহস আছে। কে বলে চেঁচিয়ে ওঠে, আর তাতেই নাকি চোর পালিয়ে যায়। আমি খোকাকে জিজ্ঞেস করলুম।–তোমার ভয় করল না? তাতে সে বললে যে বাড়িতে খুন হবার পর থেকে নাকি সে বালিশের তলায় মেশিনগান নিয়ে শোয়, আর সেই কারণেই নাকি তার ভয় নেই।
দশটার সময় লালমোহনবাবু এসে হাজির। ফেলুদাকে গভীর দেখে ভদ্রলোক ভারী ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। –সে কী মশাই, আপনি এখনও অন্ধকারে নাকি?
কী করি বলুন—রোজ যদি একটা করে নতুন রহস্যের উদ্ভব হয়, তা হলে ফেলু মিত্তির কী করে?
আবার রহস্য?
খোকার ঘরে চার ঢুকেছিল কাল রাত্তিরে।
বলেন কী? চোরের কি কোনও বাছবিচার নেই? মুড়ি-মিছরি এক দর?
এখন আপনার উপর ভরসা।
হুঁ—চন্দ্ৰ-সূৰ্য অস্ত গেল, জোনাক ধরে বাতি–ভীষ্ম দ্ৰোণ কৰ্ণ গেল, শল্য হল রখী! তবে হ্যাঁ-চন্দনার ব্যাপারটা কিন্তু আমায় হনটি করছে। ওটা নিয়ে একটা আলাদা তদন্ত করা উচিত। আপনার সময় না থাকলে আমি করতে রাজি আছি। তিনকড়িবাবুর দোকানে আমার খুব যাতায়াত ছিল এককালে।
সে কী, এটা তো বলেননি। আগে।
আরে মশাই, এককালে খুব পাখির শখ ছিল আমার। একটা ময়না ছিল, সেটাকে মেঘনাদবধ কাব্যের প্রথম লাইন আবৃত্তি করতে শিখিয়েছিলাম।
জল পড়ে পাতা নড়ে দিয়ে শুরু করা উচিত ছিল আপনার।
ভদ্রলোক ফেলুদার খোঁচটা অগ্ৰাহ্য করে আমার দিকে ফিরে বললেন, কী হে তপেশীবাবু, যাবে নিউমার্কেট?
ফেলুদা বলল, যেতে হয় তো বেরিয়ে পড়ুন। আমি ঘণ্টাখনেক পরে আপনাদের মিট করব।
কোথায়?
নিউ মার্কেটের মধ্যিখানে, কামানটার পাশে। বিস্তর ঘোরাঘুরি আছে, বাইরে খাওয়া আছে।
সপ্তাহে এক দিন রেস্ট্রর্যান্টে খাওয়াটা আমাদের রেগুলার ব্যাপার।
লালমোহনবাবুর গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়লাম।
নিউ মার্কেটের পাখির বাজারের জবাব নেই। তবে তিনকড়িবাবু যে জটায়ুকে চিনবেন না। তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই, কারণ ভদ্রলোক এ দোকানে শেষ এসেছেন সিক্সটি এইটে। লালমোহনবাবু এক গাল হেসে চিনতে পারছেন? জিজ্ঞেস করাতে তিনকড়িবাবু তাঁর মোটা চশমার উপর দিয়ে লালমোহনবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, চেনা মুখ তো ভুলি না চট করে। নাকু বাবু তো? আপনি কারবালা ট্যাঙ্ক রোডে থাকেন না?
লালমোহনবাবুর চুপিসানো ভাব দেখে আমিই কাজের কথাটা পাড়লাম।
আপনার এখান থেকে গত দিন দিশেকের মধ্যে কি কেউ একটা চন্দনা কিনে নিয়ে গেছে? বারাসতের এক ভদ্রলোক?
বারাসতে কিনা জানি না, তবে দুখানা চন্দনা বিক্রি হয়েছে দিন দশোকের মধ্যে। একটা নিল জয়শক্তি ফিলিম কোম্পানির নেপেনবাবু। বলল চিন্ময়ী মা না মৃন্ময়ী মা কী একটা বইয়ের শুটিং-এ লাগবে। ভাড়ায় চাইছিল—আমি বললুম। সে দিন আর নেই। নিলে ক্যাশ দিয়ে নিয়ে যান, কাজ হয়ে গেলে পর আপনাদের হিরোইনকে দিয়ে দেবেন।
আর অন্যটা যে বেচলেন, সেটা কেথেকে এসেছিল। আপনার দোকানে মনে আছে?
কেন মশাই, অন্ত ইনফরমেশনে কী দরকার?
ভদ্রলোক একটু সন্দিগ্ধ বলে মনে হল।
সেই পাখিটা খাঁচা থেকে চুরি গেছে অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে, বললেন লালমোহনবাবু, সেটা ফিরে পাওয়া দরকার;
ফিরে পেতে চান তো কাগজে অ্যাডভারটাইজ দিন।
তা না হয় দেব, কিন্তু আপনার দোকানে কেখেকে এসেছিল সেটা–
অতশত বলতে পারব না। আপনি অ্যাডভারটাইজ দিন।
পাখিটা কথা বলত কি?
তা বলবে না কেন? তবে কী বলত জিজ্ঞেস করবেন না। সতেরোটা টকিং বার্ড আছে আমার দোকানে। কেউ বলে গুড মর্নিং, কেউ বলে ঠাকুর ভাত দাও, কেউ বলে জয় গুরু, কেউ বলে রাধাকেষ্ট-কোনটা কোন পাখি বলে সেটা ফস করে জিজ্ঞেস করলে বলতে পারব না।
আধা ঘণ্টা সময় ছিল হাতে, তার মধ্যে লালমোহনবাবু একটা নখ কাটার ক্লিপ, আধা ডজন। দেশবন্ধু মিলসের গেঞ্জি আর একটা সিগন্যাল টুথপেস্ট কিনলেন। তারপর চীনে জুতোর দোকানে গিয়ে একটা মোকসিনের দাম করতে করতে আমাদের অ্যাপায়স্টমেন্টের সময় এসে গেল! আমরা কামানের কাছে যাবার তিন মিনিটের মধ্যেই ফেলুদা হাজির।
এবার কোথায় যাওয়া? মার্কেট থেকে বাইরে এসে জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু।
বলেন কী? সেই সিরাজদ্দৌলার অ্যামল থেকে?
সেই রকম একটি প্রাচীন পাশি বাড়িতে এখন যাব আমরা। ঠিকানা হচ্ছে।–ফেলুদা পকেট থেকে খাতা বার করল
একশো তেত্ৰিশের দই বৌবাজার স্ট্রিট।