টিভিতে শার্লক হোমস দেখে ফেলুদা মুগ্ধ। বলল, একেবারে বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছে। হোমস আর ওয়াটসন। জানিস তোপ্সে-আমাদের যা কিছু শিক্ষা দীক্ষা ওই শার্লক হামসের কাছে। সব প্রাইভেট ডিটেকটিভের গুরু হচ্ছে হোমস। তাঁর সৃষ্টিকর্তা কন্যান ডয়েলের জবাব নেই?
জটায়ু সায় দিয়ে বললেন, লোকটা কত গল্প লিখেছে ভাবুন তো! এত প্লট কী করে যে মাথায় আসে সেটা ভেবে পাই না। সাধে। কী আমার টাক পড়েছে? প্লট খুঁজতে গিয়ে মাথার চুল ছিঁড়ে!
বাইরে বৃষ্টি পড়েছে, তার মধ্যে চা আর ডালমুটটা জমেছে ভাল। আসলে লালমোহনবাবুও একচল্লিশটা রহস্য উপন্যাস লিখেছেন, কিন্তু তার বেশির ভাগই ফেলুদার ভাষায় থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়। তবে প্রটের জন্য মাথা খুঁড়লেও ভদ্রলোকের উৎসাহের অভাব নেই। আর সত্যি বলতে কী, ফেলুদার সঙ্গে বন্ধুত্ব হবার পর থেকে ওঁর গল্পও অনেক ইমপ্রুভ করে গেছে।
শ্ৰীনাথকে একটু বলো না ভাই তপেশ, বললেন লালমোহনবাবু, আর এক কাপ চা হলে মন্দ হত না।
আমি শ্ৰীনাথকে চায়ের ফরমাশ দিয়ে আসতেই দরজায় টোকা পড়ল। তার আগে অবশ্য ট্যাক্সি থামার শব্দ পেয়েছি।
দরজা খুলে দেখি ছাতা মাথায় এক ভদ্রলোক, মাঝারি হাইট, ফরসা রং, দাড়ি গোঁফ কামানো, বয়স চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ।
বললাম, কাকে চাই? অবিশ্যি এ প্রশ্নটা না করলেও চলত, কারণ দেখেই বুঝেছি মক্কেল।
এটা কি প্রদোষ মিত্রের বাড়ি? প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক।
এবারে ফেলুদাই বলে উঠল, আপনি আসুন ভিতরে।
ভদ্রলোক ছাতাটা বন্ধ করে ঢুকলেন।
ওটাকে দরজার পাশে রেখে দিন, বলল ফেলুদা।
ভদ্রলোক তাই করলেন, তারপর সোফার এক পাশে এসে বসলেন। ফেলুদা বলল, আমার নাম প্রদোষ মিত্র; আর ইনি আমার বন্ধু লালমোহন গাঙ্গুলী।
যাক, তবু আপনাকে বাড়ি পাওয়া গেল, বললেন ভদ্রলোক, টেলিফোন করে কানেকশন পাইনি। আজকাল যা হয় আর কী।
কী ব্যাপার বলুন।
বলছি। আগে আমার পরিচয়টা দিই। আমার নাম মহীতোষ রায়। নাম শুনে চিনবেন ততটা আশা করি না, যদিও থিয়েটার লাইনে আমার কিছুটা খ্যাতি আছে।
আপনি তো অপ্সরা থিয়েটারে আছেন, তাই না?
ঠিকই ধরেছেন। এখন প্ৰফুল্লতে অভিনয় করছি।
হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি।
আপনার কাছে এসেছি একটা সংকটে পড়ে।
কী সংকট?
কদিন থেকে আমি হুমকি চিঠি পাচ্ছি। কার কাছ থেকে তা বলতে পারব না।
হুমকি চিঠি?
তার কিছু নমুনা আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। এই দেখুন।
ভদ্রলোক পকেট থেকে চারটে কাগজ বার করলেন, তারপর সেগুলো টেবিলের উপর রাখলেন। আমি দেখলাম একটায় লেখা সাবধান!। আরেকটায় তোমার দিন ফুরিয়ে এল, আরেকটায় তোমার দুষ্কৃতির ফল ভোগ কর, আর চার নম্বরটায় আর সময় নেই। এবার ইষ্টনাম জপ কর! গোটা গোটা বড় বড় অক্ষরে লেখা, আর সবই যে এক লোকের লেখা তা বোঝাবার উপায় নেই।
এ সব কি ডাকে এসেছে? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
এগুলো কদিনের মধ্যে পেয়েছেন?
সাতদিন।
কে লিখেছে। কিছু অনুমান করতে পেরেছেন?
একেবারেই না।
আপনার প্রতি বিরূপ এমন কোনও লোকের কথা মনে করতে পারছেন না?
দেখুন, আমি থিয়েটারে কাজ করি। আমাদের মধ্যে ছাটখাটা ঝগড়া, মনামালিন্য—এ লেগেই আছে। আমি দুবছর হল অপ্সরায় আছি, তার আগে রূপমঞ্চে ছিলাম। আমাকে নেওয়া হয় একটি অভিনেতার জায়গায়। স্বভাবতই সে অভিনেতা এতে সন্তুষ্ট হয়নি। সে নিশ্চয়ই ঈর্ষায় ভুগছে।
এই অভিনেতার নাম কী?
জগন্ময় ভট্টাচাৰ্য। ভয়ানক ড্রিঙ্ক করতে শুরু করেছিল। তাই তাকে আর রাখা যায়নি। তিনি এখন কী করছেন কোথায় আছেন তা জানি না।
এই জগন্ময় ভট্টাচাৰ্য ছাড়া আর কারুর কথা মনে পড়ছে? আমার একটি ছোট ভাই আছে, তার সঙ্গে আমার বনে না। সে অবিশ্যি আলাদা থাকে। আমার বাবার মৃত্যুতে সম্পত্তি সব আমি পাই। আমার ছোট ভাই অসৎ সঙ্গে পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। বাবা তাই তাকে উইল থেকে বাদ দেন। ছোট ভাই স্বভাবতই খুব অসন্তুষ্ট হয়। এ ছাড়া শত্রু বলতে আর কাউকে মনে পড়ে না।
আপনি সাবধানে আছেন তো?
তা তো আছি, কিন্তু আপনি যদি একটু পথ বাতলে দেন।
এ ব্যাপারে সাবধানে থাকতে বলা ছাড়া তো আর কিছু বাতলাবার নেই। আপনি থাকেন কোথায়?
বালিগঞ্জে। পাঁচ নম্বর পণ্ডিতিয়া প্লেস।
একই থাকেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ। একটি চাকর আর একটি রান্নার লোক আছে। আমি এখনও বিয়ে করিনি।
সত্যি বলতে কী, এ অবস্থায় আমার আর কিছুই করার নেই। এরকম হুমকি কেস আমার কাছে আগেও এসেছে। চিঠিগুলো থেকে কিছু ধরা যায় না। এখানে চারটি চিঠিতে দেখছি।চার রকম পোস্টমার্ক, কাজেই কোথেকে এসেছে তাও বলা যায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখেছি শেষ পর্যন্ত কিছুই হয় না। তবে আপনাকে কেউ উৎকণ্ঠায় ফেলতে চাচ্ছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমি বলি কী আপনি পুলিশে যান। তারা এসব ব্যাপারে আরও ভাল ব্যবস্থা করতে পারে।
ভদ্রলোক যেন একটু মুষড়ে পড়লেন, বললেন, পুলিশ?
কেন, পুলিশের বিরুদ্ধে আপনার কোনও অভিযোগ আছে নাকি?
না, তা নেই।
তবে আর কী। আপনি সোজা থানায় গিয়ে রিপোর্ট করুন। আমায় যা বললেন তাই বলুন।
ভদ্রলোক অগত্যা উঠে পড়লেন। ফেলুদা তাঁকে দরজা অবধি পৌঁছে দিল। তারপর ফিরে এসে বসে পড়ে বলল, ভদ্রলোকের ডান হাতের আঙুলে একটা আংটির দাগ দেখলাম। সেই আংটিটি কোথায় গেছে কে জানে।
বেচে দিয়েছেন বলছেন? জটায়ু প্রশ্ন করলেন।
দিলে আশ্চর্য হব না। পায়ের জুতো জোড়ার অবস্থাও বেশ খারাপ। প্রফুল্লতে উনি প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করছেন না সেটা জানি। সেটা করছেন অপ্সরার স্টার অভিনেতা নেপাল লাহিড়ী।
কিন্তু কে ওঁর পিছনে লেগেছে বলে তো, আমি প্রশ্ন করলাম।
কী করে বলব বল। উনি যে দুজনের কথা বললেন তাদের একজন হতে পারে। মোটকথা এ কেস আমার নেওয়া চলে না। আর অনেক সময় এগুলো স্রেফ ভাঁওতার উপর চলে। আমার কত টেলিফোন এসেছে বুলি তো হুমকি দিয়ে! সে সব মানতে হলে তো বাড়িতে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে হয়।
কিন্তু এই চিঠির ব্যাপারটা যে ভাঁওতা নয় সেটা তিন দিন পরেই জানলাম।
খবরটা জানা গেল খবরের কাগজ মারফত। ছোট করে লেখা খবর-অন্সর থিয়েটারের অভিনেতা নিখোঁজ। মহীতোষ রায় নাকি সন্ধ্যাবেলা থিয়েটার না থাকলে লেকের ধারে বেড়াতে যেতেন। গত পরশু, অর্থাৎ সোমবার, তিনি যথারীতি বেড়াতে গিয়ে আর বাড়ি ফেরেননি। বাড়ির চাকর থানায় গিয়ে খবর দেয়। পুলিশ এই নিয়ে তদন্ত চালাচ্ছে।
ফেলুদা বিরক্ত হয়ে বলল, লোকটাকে পই পই করে বলেছিলাম সাবধানে থাকতে, তার লেকে বেড়াতে যাবার কী দরকার ছিল? যাই হোক, আমার কাছে যখন এসেছিলেন ভদ্রলোক, তখন একবার ওঁর বাড়িতে যাওয়া দরকার। ঠিকানাটা মনে আছে?
পাঁচ নম্বর পণ্ডিতিয়া প্লেস।
গুড। তোর স্মরণশক্তি পরীক্ষা করছিলাম।
নটা নাগাদ আমরা বেরিয়ে পড়লাম।
পাঁচ নম্বর পণ্ডিতিয়া প্লেস একটা ছোট্ট দোতলা বাড়ি, তার একতলায় থাকতেন মহীতোষবাবু। চাকর দরজা খুলে দিলে আমরা নিজেদের পরিচয় দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। ফেলুদা চাকরকে বলল, তোমার মনিব আমার কাছে এসেছিলেন সাহায্য চাইতে। উনি মাঝে মাঝে হুমকি চিঠি পাচ্ছিলেন সে খবর তুমি জান?
জানি বইকী বাবু! আমি বাইশ বছর ওনার কাজ করছি। আমাকে সব কথাই বলতেন। আমি ওঁকে অনেক করে বলেছিলাম-আপনি বেড়াতে যাবেন না, বাড়িতে থাকুন, সাবধানে থাকুন। তা উনি আমার নিষেধ শুনলেন না। যখন দেখলাম রাত সাড়ে নটা হয়ে গেল তাও আসছেন না, তখন আমি নিজেই গেলাম লেকে। কোনখানটায়। উনি বসতেন, কোনখানটায় বেড়াতেন, সেটা আমি জানতাম। কিন্তু কই, তাঁকে তো কোথাও দেখতে পেলাম না। তারপর পুরো একটা দিন কেটে গেল, এখনও কোনও খবর নেই। আমি থানায় গেলাম। তেনারা সব লিখে-টিখে নিলেন, কিন্তু এখনও পর্যন্ত তো কিছুই হল না।
ফেলুদা বলল, তুমি এখন আমাদের সঙ্গে একবার আসতে পারবে? লেকে যে জায়গাটায় বসতেন সেটা যদি একবার দেখিয়ে দাও।
চলুন বাবু, যাচ্ছি।
তোমার নাম কী?
দীনবন্ধু, বাবু!
আমরা তিনজন ট্যাক্সি করে লেকে গিয়ে হাজির হলাম।
জলের ধারে একটা আমলকী গাছের পাশে একটা বেঞ্চি, তাতেই নাকি হাঁটা সেরে বসতেন। ভদ্রলোক। হাঁটার অভ্যাসটা ডাক্তারই বলে বলে করিয়েছিলেন। এখন চতুর্দিকে কোনও লোক নেই, ফেলুদা খুব মন দিয়ে বেঞ্চি আর তার চারপাশটা পরীক্ষা করে দেখল। প্রায় মিনিট পাঁচেক তন্ন তন্ন করে খুঁজে ঘাসের মধ্যে একটা পিতলের কৌটো পেল। দীনবন্ধু সেটা দেখামাত্র বলে উঠল, এ কৌটো তো বাবুর ছিল। কেঁটাটা খুলে ভিতরে এলাচ আর সুপুরি পাওয়া গেল! ফেলুদা সেটা পকেটে পুরে নিল। তারপর দীনবন্ধুকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি ভবানীপুর থানায় খবর দিয়েছিলে?
আজ্ঞে হ্যাঁ বাবু।
ঠিক আছে। চলো তোমাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আমরা একটু থানায় খবর দিয়ে আসি। মোটামুটি কলকাতার বেশির ভাগ থানার ওসি-র সঙ্গেই ফেলুদার আলাপ আছে। ভবানীপুর থানার ওসি হচ্ছেন সুবোধ অধিকারী। আমরা দীনবন্ধুকে পণ্ডিতিয়া প্লেসে নামিয়ে দিয়ে গেলাম অধিকারীর সঙ্গে দেখা করতে। রাশভারী হলেও বেশ মাইডিয়ার লোক, আর ফেলুদাকে খুব পছন্দ করেন। আমাদের দেখে একটু অবাক হয়েই বললেন, কী ব্যাপার, এত সকাল সকাল?
আমরা দুটো চেয়ারে বসলাম।
ফেলুদা বলল, একটা ডিসপিয়ারেন্সের কেস আপনাদের কাছে রিপোর্টেড হয়েছে। মহীতোষ রায়।
হ্যাঁ। এটা বোধহয় সত্যবান দেখছিল। দাঁড়ান, ওকে ডাকি। একটু চা চলবে?
তা। আপত্তি নেই।
মিনিট খানেকের মধ্যেই ইনস্পেক্টর সত্যবান ঘোষ এসে গেলেন। ইনিও ফেলুদার যথেষ্ট চেনা; দুজনে হ্যান্ডশেক করার পর সত্যবান বললেন, কী ব্যাপার বলুন।
মহীতোষ রায় বলে একটি অভিনেতা বোধহয় নিরুদ্দেশ হয়েছেন?
নিরুদ্দেশ কেন, আমার তো মনে হয় তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তাঁর বাড়ি থেকে বেশ কয়েকটা হুমকি চিঠি পাওয়া গেছে। আর লেকের ধারে মেরে ফেলে গায়ে কিছু ভারী জিনিস বেঁধে লাশ জলে ফেলে দিলে সে তো আর পাওয়াও যাবে না। আপনি এ ব্যাপারে কী করে ইন্টারেস্টেড হলেন?
ফেলুদা মহীতোষবাবুর আসার কথাটা বলল। তারপর প্রশ্ন করল, আপনারা কোনওরকম এগোবার রাস্তা খুঁজে পাননি বোধহয়?
ঘোষ বললেন, ভদ্রলোক অন্সর থিয়েটারে অভিনয় করতেন। আমরা সেখানে খোঁজ করেছি, কিন্তু কিছু এগোতে পারিনি। থিয়েটারের কারুর সঙ্গে এমন শক্ৰতা ছিল না যে খুন হতে পারে। পেটি জেলাসি সব সময়ই থাকতে পারে, কিন্তু সেটা খুনের কারণ হয় না।
ভদ্রলোকের আর্থিক অবস্থা কেমন ছিল?
মোটামুটি। বারোশো টাকা মাইনে পেতেন। একা মানুষ, তাই চলে যেত। অবিশ্যি খুনই যে হয়েছে একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। ভদ্রলোককে কেউ হয়তো ফুসলে নিয়ে গোসল, কিংবা ভদ্রলোক হয়তো নিজেই কোনও কারণে গা ঢাকা দিয়েছেন।
আমি আজ লেকের ওখানে গিয়েছিলাম। ভদ্রলোক যে বেঞ্চিতে বসতেন তার পাশেই ঘাসে ওঁর একটা মশলার কৌটো পাই।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ।
তা হলে তো খুন বলেই মনে হচ্ছে! আততায়ীর সঙ্গে স্ট্রাগলের সময় পকেট থেকে কোটাটা পড়ে গেছিল।
তাই তো মনে হচ্ছে।
ঠিক আছে। আমাদের এদিক থেকে কোনও খবর পেলে আপনাকে জানাব।
ভেরি গুড। আমিও আপনাদের টাচে থাকব।
মিঃ ঘোষ চলে গেলেন। চা এসে গিয়েছিল, আমরা চা খেয়ে উঠে পড়লাম।
বাইরে বেরিয়ে এসে ফেলুদা বলল, একবার অন্সর থিয়েটারে যাওয়া দরকার। ওই কেমিস্টের দোকান থেকে লালমোহনবাবুকে একটা ফোন করে বলে দে উনিও যেন চলে আসেন।
ফোন করে আমরা আবার ট্যাক্সি ধরলাম। যেতে হবে সেই শ্যামবাজার।
❤️