প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে
কে তুমি,
মেলেনি উত্তর।
বৎসর বৎসর চলে গেল,
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম-সাগরতীরে
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়
কে তুমি,
পেল না উত্তর।
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রাণ বা জীবন নিয়ে কেবল প্রাণিবিজ্ঞানী কিংবা জীববিজ্ঞানীরাই যে সবসময় ভেবেছেন তা কিন্তু নয়। প্রাণের গােলকধাধার দুর্জ্ঞেয় রহস্য আর মায়াবী মুখচ্ছবি যুগে যুগে পুরােমাত্রায় আলােড়িত করেছে অন্য শাখার বিজ্ঞানীদেরও। আজ হতে প্রায় বাষট্টি বছর আগে নােবেল বিজয়ী অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ অর্ভিন শ্রোডিংগার একটি বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে উচ্চারণ করেছিলেন দুই শব্দের শতাব্দী-প্রাচীন সেই দার্শিনিক পংক্তিমালা – ‘জীবন কি’ (What is life)? যে সমস্যাটিকে এতদিন ধরে ভাবা হত কেবলই জীববিজ্ঞানের অন্তর্নিহিত সমস্যা হিসেবে, অধ্যাপক শ্রোডিংগার সে সমস্যাটিকে বিস্তৃত করে ব্যাখ্যা দিলেন পদার্থ বিজ্ঞান আর রসায়ন বিজ্ঞানের কিছু নিয়ম কানুন দিয়ে, প্রথমবারের মত।

সেই থেকে শুরু। সে সেমিনারে প্রদত্ত ভাষণগুলাে নিয়ে ১৯৪৪ সালে লিখিত What is life? নামের সেই যুগান্তকারী বইটিতে শ্রোডিংগার জীবনকে দেখতে চেয়েছেন এক বিদঘুটে ধরনের ‘অনাবর্তী কেলাস’ (Aperiodic Crystal) হিসেবে যার গাঠনিক আকারের বৈচিত্রময় পুনরুৎপত্তি এবং বিবর্ধন ঘটে। তবে জীবন যে কেবল ‘অনাবর্তী কেলাস’ নয়, বরং এর অভিব্যক্তি যে আরাে গভীর – সেটা শ্রোডিংগার নিজেই বুঝেছিলেন আর বলেছিলেন, ‘জীবনের জটিলতাকে কেলাসের সাথে তুলনা করা হবে যেন এক নিরস ওয়াল পেপারের সাথে সূক্ষ্ম অভিব্যক্তিখচিত এক নক্সিকাঁথার তুলনা’!
জীবনকে বুঝবার ক্ষেত্রে শ্রোডিংগারের বইটির অবদান কিন্তু সত্যই ব্যাপক। বইটি লেখার প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে ডিএনএ’র যুগল সর্পিলের রহস্যভেদকারী নােবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ওয়াটসন আপ্লুত হলেন শ্রোডিংগার বন্দনায়, খুব স্পষ্ট করেই কিন্তু বললেন, সতেরাে বছর বয়সে যদি এই বইটি পড়ার সুযােগ না হত, তবে হয়ত তাঁর জেনেটিক্স নিয়ে পড়াশােনা করার আগ্রহই কখনও সৃষ্টি হত না! বুঝুন কী কান্ড! ঠিক একইভাবে ফ্রান্সিস ক্রিক তাঁর ‘What Mad Pursuit’ বইয়ে ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে শ্রোডিংগারের এই মহামূল্যবান বইটি একসময় তাকে উৎসাহিত করেছিল জেনেটিক্সের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ভাবতে।
তবে বইটির অবদান কেবল ক্রিক-ওয়াটসনকে ডিএনএর রহস্য সমাধানে আগ্রহী করে নােবেল বিজয়ী হতে সহায়তা করা নয়, বরং এর আবেদন অনেক গভীরে। এ বইটিই প্রথমবারের মতাে আমাদের বুঝতে শিখিয়েছে যে, জীবনকে জানতে হলে, মূলতঃ জীবনের। উৎস সন্ধান করতে হলে শুধু জীববিজ্ঞানী হয়ে বসে থাকলে চলবে না, একই সাথে পরিচিত হতে হবে পদার্থবিদ্যা আর রসায়নবিদ্যার বর্ণাঢ্য জগতের সাথে। সেটিই খুব পরিস্কার করেন আরেক নােবেল বিজয়ী পদার্থবিদ স্টিভেন ভাইনবার্গ তাঁর Facing Up : Science and Its Cultural Adversaries গ্রন্থে এভাবে :
No biologist today will be content with an axiom about biological behaviors that could not be imagined to have a more fundamental level. That more fundamental level would have to be the level of Physics and chemistry, and the contingency that the earth is billions of years old.
ব্যাপারটা খুবই পরিস্কার। প্রাণের উৎসমুখে মানে গােড়ায় কিন্তু ডায়নােসার, বাঘ, ভালুকের মত কোন অতিকায় প্রাণী নেই, নেই আমাদের পরিচিত পৃথিবীর জীবজগতের নানাপদের বৈচিত্র। প্রাণের উৎপত্তির মূলে যা আছে তা খুবই কাঠ খােট্টা-নিষ্প্রাণ কতকগুলাে সাদামাঠা রাসায়নিক পদার্থ। তাই জীবনকে বুঝতে হলে এই কাঠখােট্টা পদার্থগুলাে সম্বন্ধে জানা চাই, ভাল করে বােঝা চাই। মজার ব্যাপার হচ্ছে যে, জীবনের গঠনকে সাধারণভাবে যত জটিল বলে মনে করা হয়, ততটা জটিল কিন্তু মােটেই নয়, বরং জীবনের প্রাথমিক ভিত্তিমূল অবিশ্বাস্য রকমের সরল। আপনারা বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, জীবনের ভিত্তি তৈরী হয়েছে মাত্র চারটি সাধারণ মৌলিক পদার্থ দিয়ে : কার্বন (C), হাইড্রোজেন (H), অক্সিজেন (O) এবং নাইট্রোজেন (N); সংক্ষেপে বলে CHON। সালফার আর ফসফরাসকে গােনায় ধরলে মূল উপাদান দাঁড়ায় ছ’টি তে – CHON(SP)। এই উপাদানগুলােকে মাথায় রেখেই মূলতঃ জীবনকে সংজ্ঞায়িত করার কাজটি আমাদের আরম্ভ করতে হবে, কারণ জন্মের পর থেকেই যে বৈচিত্রময় জীবজগতের সাথে আমরা পরিচিত হয়েছি, তার শতকরা ৯৯.৯৯ ভাগই কিন্তু তৈরী হয়েছে এই ‘খুন’ (CHON) দিয়ে।

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে সব ছেড়ে ছুড়ে এই ‘খন’ কেন? কেন লােহা, তামা, সােনা, টাইটেনিয়াম কিংবা ক্রিপটন নয়, কিংবা নয় আর কোন বিজাতীয় সংকর? উত্তরটা কিন্তু সােজা। জীবনের গঠন খন দিয়ে শুরু হয়েছে কারণ, প্রকৃতিতে এই উপাদানগুলাের একচ্ছত্র আধিপত্য আর প্রাচুর্য রয়েছে – সেই উৎপত্তির প্রারম্ভ থেকেই। যে পাঁচটি মৌল কণিকা এ বিশ্ব-চরাচরে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, তার চারটিই হচ্ছে খন৷ অপর মৌলটি হল হিলিয়াম (He)। কিন্তু হিলিয়াম এতােটাই ঘরকুনাে, মানে রাসায়নিক ভাবে নিষ্ক্রিয় যে খনএর সদস্যরা হিলিয়ামের সাথে কোন বন্ধুত্বই গড়ে তুলতে পারে নি। কাজেই হিলিয়াম বেচারার এক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যই বলতে হবে যে, ছােট বাচ্চাদের গ্যাস বেলুনের মধ্যে সেঁদিয়ে থাকা ছাড়া জীবনগঠনে তার কোন ভুমিকা নেই।
প্রকৃতিতে খন্ বাবাজীর প্রচুর পরিমানে থাকাটাই প্রাণ সৃষ্টির পেছনে একমাত্র কারণ নয়, বরং পাশাপাশি এও দেখা গেছে এরা আবার একে অপরের সাথে মিলে নানা ধরােনের যৌগ উৎপন্ন করতে পারছে- যেমন মিথেন (CH4), কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2), অ্যামােনিয়া (NH3) ইত্যাদি। এ যৌগগুলাে যেহেতু আবার পানিতে সহজেই দ্রবীভূত হয়ে যায়, এগুলাে জীবন গঠনের পেছনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পানির ব্যাপারটা কিন্তু মােটেই হেলাফেলা করবার নয়; কারণ যে কোন জীবদেহে – সে আমাদের মানব দেহই হােক আর কুমড়া কিংবা লেটুস পাতার ডগাই হােক – বিরাট একটা অংশ জুড়ে রয়েছে কেবল পানি আর পানি! জীবদেহের এই জলীয় অংশটা আসলে সুদূর অতীতে প্রাণের স্পন্দন যে একটা জলজ পরিবেশে ঘটেছে আর বিবর্তিত হয়েছে, তার এক অবশ্যাম্ভাবী সাক্ষী।