আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মতরে এই ‘জলীয় তথ্য’ কোষের মধ্যে বহন করে চলেছি। ফলে দেখা যাচ্ছে ব্যাকটেরিয়া থেকে ছত্রাক, ছত্রাক থেকে কোলা ব্যাঙ, কোলা ব্যাঙ থেকে তিমি মাছ, কিংবা তিমি মাছ থেকে মানুষ – পৃথিবীতে প্রাণের যে বিস্তৃত পরিসর আমাদের হতবিহ্বল করে মূক করে দেয়, সেটি কিন্তু এক্কেবারেই সরল একটা পর্যায়ে নেমে আসে প্রাণের উৎসমুখে এসে।

সেই উৎসমুখে অর্থাৎ প্রাণের রাসায়নিক স্তরে নেমে আসলে দেখা যায়, সমস্ত প্রাণ – তা তিমি মাছেরই হােক, কিংবা মানুষেরই হােক, শেষ পর্যন্ত গড়ে উঠেছে ওই CHON(SP) দিয়ে।
কাজেই নির্দ্বিধায় বলা যায় এই খই হল ‘জীবন’ গঠনের প্রাথমিক ধাপ। এই ধাপের উপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছে পরবর্তী ধাপ গুলাে – অ্যামিনাে এসিড, চিনি, ডিএনএ, আরএনএ কিংবা অন্যান্য মনােমার। ওগুলাের উপর ভর করেই আবার পরবর্তীতে তৈরী হয়েছে বিভিন্ন পলিমারের অন্য যেমন – প্রােটিন, শর্করা কিংবা নিউক্লিয়িক এসিড- এগুলাে সবগুলােই কিন্তু জীবন গঠনের নিয়ামক জীবন সৌধের এক একটি সিড়ি; তারপরও একথাও সত্যি যে, এগুলাে কোনটাই নিজেরা আলাদাভাবে ‘জীবন’ নয়।
ব্যাপারটিকে অনেকটা আমাদের মস্তিকের চিন্তাশক্তি অথবা সচেতনার সাথে তুলনা করা যায়। আলাদা আলাদা ভাবে মাথার মধ্যকার লক্ষ লক্ষ নিউরনগুলাের কোনটিই কিন্তু এককভাবে চিন্তা করতে পারে না, কিন্তু এই ‘নির্বোধ’ নিউরনগুলােই সম্মিলিতভাবে এক ধরণের অভিব্যক্তির জন্ম দেয় যাকে আমরা বলি কনশাসনেস বা চেতনা! প্রাণও কিন্তু অনেকটা এরকমই – নিষ্প্রাণদের সমন্বয়ে গড়ে উঠা এক ধরণের সম্মিলিত সজীব অভিব্যক্তি।
প্রথম অধ্যায়ে বলা হয়েছিল যে, জীবন সম্পর্কে যে কোন মৌলিক প্রশ্ন তুলবার আগে জীবনের সনাক্তকরণটি জরুরী। কিভাবে জীবিত ও জড় – এ দুই জাতের পদার্থকে একটু মাপকাঠি দিয়ে আলাদা করা যায়? বহিরাঙ্গের গঠন ও আকৃতি অবশ্যই একটা মাপকাঠি। তবে বহিবৈশিষ্টের পাশাপাশি আরও দুটি আচরণ, যেমন অবিকল নকলরূপী ভবিষ্যত তৈরি করা এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ অবস্থানকে জীবিতদের গুণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের সংজ্ঞায়ও সমস্যা আছে। সমস্যা হয় ভাইরাসকে নিয়ে, আবার সমস্যা হয় কেলাসকে নিয়ে।
জড় পদার্থের ক্ষেত্রে কেলাস ক্ষুদ্র মাপের কেলাস কণাকে আশ্রয় করে জন্ম নেয়। আবার অনাদরে ফেলে রাখলে কেলাসের জ্যামিতিক অবয়ব বিনষ্ট হয়, যা এক প্রকার ‘মৃত্যু’। কেলাসের বৃদ্ধি তাে আছেই। কেলাসের কণা তরল দ্রবণের মধ্যে অথবা গলিত পদার্থের মধ্যে তার স্বজাতিকে নির্বাচন করে ‘অবিকল নকলরূপী’ ভবিষ্যতের সৃষ্টি করতে পারে। ফলে জন্ম নেয় দ্বিতীয় প্রজন্মের কেলাস। এত মিল থাকা সত্ত্বেও আমরা সকলেই জানি কেলাস জীবিত পদার্থ নয়, কারণ কেলাসের খাদ্য-শােষনের ব্যবস্থা নেই, বিপাক প্রক্রিয়া নেই, নেই আর কোন জটিল শারীরিক প্রক্রিয়া।
আবার ভাইরাসের কথা চিন্তা করা যাক। ভাইরাস জীবিত ও জড়ের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান করে। ভাইরাসকে কেউ জড় বলতে পারেন, আবার জীবিত বলতেও বাঁধা নেই। এমনিতে ভাইরাস ‘মৃতবৎ’, তবে তারা বেঁচে ওঠে অন্য জীবিত কোষকে আশ্রয় করে। ভাইরাসে থাকে প্রােটিনবাহী নিউক্লিয়িক এসিড। এই নিউক্লিয়িক এসিডই ভাইরাসের যাবতীয় বৈশিষ্ট্যের আধার।
অনেক বিজ্ঞানীই আজ মনে করেন আদিমকাল থেকেই জৈববিবর্তনে ভাইরাস এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। তাই জীবনকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে হলে ভাইরাসকে বােঝা চাই। নিউক্লিয়িক এসিড বা প্রােটিন এরা কেউ জীবিত নয়, এরা জীবনের উপাদান। নিউক্লিয়িক এসিড ও প্রােটিনের সমন্বয়ে যে ভাইরাসকেন্দ্র গড়ে ওঠে তাও জীবিত নয়, যতক্ষণ না তারা নিজের পুনরুৎপাদন করছে।
একমাত্র যখন ভাইরাস দখলকৃত কোষকে আশ্রয় করে বংশবিস্তার করতে পারে তখনই কেবল ভাইরাসকে ‘জীবিত’ বলা যেতে পারে। কাজেই বােঝা যাচ্ছে, কতকগুলাে প্রােটিনের সমন্বয়ই প্রাণ নয়, প্রাণ হচ্ছে কাজের সুনির্দিষ্ট অভিব্যক্তি। এই সক্রিয় অভিব্যক্তিই আসলে জীবনের ভিত্তি। প্রােটিনকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া চলে জীবিতদের দেহে। জীবিত বস্তু আসলে ঠিক ততক্ষণ জীবিত যতক্ষণ এর ভিতরে রাসায়নিক প্রক্রিয়া সক্রিয় থাকে। জে.বি.এস হলডেনের ভাষায়,
❝Any self-perpetuating pattern of chemical reaction, might be called alive.❞
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শরীরের কতটা জীবিত আর কতটা নয়? বৃহৎ প্রাণিদেরদের ক্ষেত্রে হয়ত এই পরিমাপের একটা অর্থ আছে কিন্তু ছােটদের ক্ষেত্রে তেমনভাবে নেই। জীবিত বস্তু যত সরল, তত বিস্তৃত এর জীবন। এককোষী অ্যামিবাকে ছিন্ন করে দু’ভাগ করলে দেখা যায় প্রতিটি ভাগের ক্ষমতা আছে নতুন জীবন তৈরি করার, যদি প্রতিটি ভাগেই নিউক্লিয়াসের অংশ থাকে। এ থেকে নিউক্লিয়াসের গুরুত্ব বােঝা যাচ্ছে। কিন্তু সাইটোপ্লাজমকে বাদ দিয়ে শুধু নিউক্লিয়াস কি পারবে নতুন অ্যামিবার জন্ম দিতে? না, পারবে না। অতএব নিউক্লিয়াস ও সাইটোপ্লাজম- এককথায় একটি পরিপূর্ণ জীবনকোষই পারে নতুন জীবনের জন্ম দিতে। কাজেই কোষই হচ্ছে জীবনের ক্ষুদ্রত্তম আধার।
এখন কোষকে জীবনের ক্ষুদ্রত্তম আধার ঘােষণা করায় ভাইরাসবাদীরা হয়ত আপত্তি করবেন। তারা বলতে পারেন, শুধু ‘নিউক্লিয়িক এসিড’ নিয়ে বেঁচে থাকা ভাইরাসরা তাে জীবিত। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে, ভাইরাসের ‘বেঁচে থাকা’ সম্ভব হয় যখন সে হাতের কাছে ভর করার মত ভিন্ন ‘জীবিত’ কোষের সাইটোপ্লাজম পায়।
আসলে জীবনের সংজ্ঞার চেয়ে জীবিত বস্তুর সংজ্ঞা অনেক বেশী সহজলভ্য। ১৮৫৮ সালের কোষ মতবাদ থেকে জীবিত বস্তুর সংজ্ঞায় পৌঁছুতে পেরেছি আমরা। উইলিয়াম কিটোনের Biological science-এর সংজ্ঞাটি হল:
Living things are chemical organizations compared of cells and capable of reproducing themselves. (জীবিত বস্তু কোষ নির্মিত রাসায়নিক পদার্থ যা পুনরুৎপত্তির ক্ষমতা রাখে।)
এই সংজ্ঞানুসারে জীবিত বস্তুর দুটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেল।
১) এটি হতে হবে কোষ নির্মিত
২) তার পুনরুৎপত্তির ক্ষমতা থাকবে (অর্থাৎ কোষ থেকে কোষ উৎপন্ন হবে)
কিন্তু ডাচ উদ্ভিদবিজ্ঞানী মার্টির্নাস বেইজারনিক ১৮৮৯ সালে এবং ১৮৯২ সালে সােভিয়েত বিজ্ঞানী দমিত্রি ইভানােবস্কি ভাইরাস আবিস্কার করলে এই কোষ মতবাদের প্রথম প্রতিপাদ্য ভেঙ্গে পড়ে। রকফেলার ইনস্টিটিউটের ডবলিউ. এম. স্ট্যালি ১৯৩৫ সালে দেখিয়েছিলেন যে, ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া এক নয়। তিনি তামাক-মােজাইক ভাইরাসের কেলাস তৈরী করলেন। বােঝার কোন উপায়ই নাই যে, কেলাসগুলাে জীবিত বস্তু।
অকোষীয় বস্তুটিতে কোন বিপাক নেই। কিন্তু তামাক গাছে প্রবেশ করিয়ে দিলে দেখা গেল তারা বিভাজিত হয়ে রােগের উৎপত্তি ঘটাচ্ছে। ভাইরাসের জীবনকে মেনে নিলে জীবনের সংজ্ঞায়ন করতে হয় অনেক ব্যাপক পরিসরে। অকোষীয় (Acellular) এবং কোষীয় (Cellular) – এ দু ধরনের জীবন বা জীবকে মেনে নিতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে জীবনের নবতর সংজ্ঞায়ন জরুরী হয়ে পড়ে। বিখ্যাত ব্রিটিশ পদার্থবিদ ও জীববিদ জে ডি বার্ণাল (১৯৫১) জীবনের সংজ্ঞায়ন করেন এভাবে :
একটি নির্দিষ্ট আয়তন বা স্থানের মধ্যে স্বচালিত রাসায়নিক প্রক্রিয়ার নাম জীবন। তিনি আরাে বললেন, ‘জীবন হচ্ছ এক অতি জটিল ভৌত রাসায়নিকতন্ত্র যা একগাদা সুসংহত বা একীভূত ও স্বনিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক ও ভৌত বিক্রিয়ার মাধ্যমে তার পরিপার্শ্বের বস্তু ও শক্তিকে স্বীয় বৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করে।

মূলতঃ পঞ্চাশের দশকের পর হতে তিনটি বৈশিষ্ট্যকে জীবনের পরিচয়জ্ঞাপক বৈশিষ্ট্য বলে মানা হচ্ছেঃ
ক) নিজের প্রতিলিপি তৈরী করা
খ) মিউটেশন ঘটনাের ক্ষমতা
গ) ডারউইনীয় বিবর্তন।
কোষীয় ও অকোষীয় নির্বিশেষে জীবের একটি রাসায়নিক দ্রব্যের মধ্যে উক্ত তিনটি অনন্য বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। জীবনের মূল উপাদানটি নিউক্লিয়িক এসিড (মুলতঃ ডিএনএ আরএনএ)। এটি জড় বস্তু হলেও নিজের অনুলিপি তৈরী করে ও বেস অনুক্রমে পরিবর্তন ঘটিয়ে বিরল মিউটেশন ঘটায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে ডিএনএ জড় বস্তু হলেও তাতে জীবনের দুটি মৌলিক লক্ষণ প্রকাশিত। কিন্তু তারপরও কোষের সাহায্য ছাড়া ডিএনএ একা দুটি কাজ করতে পারে না। এনজাইম হচ্ছে প্রােটিন। সুতরাং ডিএনএ এবং প্রােটিনের উৎপত্তি জীবনের। উৎপত্তির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
জীবনের উৎপত্তি কোথা থেকে – এ প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সকলেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জানি জীবনের প্রারম্ভ ঘটে জীবন থেকেই, জীবনই তৈরি করে পরবর্তী প্রজন্মকে; কিন্তু ধারণা করা হয় যে প্রথম জীবন জন্ম নিয়েছিল অজৈব পদার্থ থেকে। জীবন যদি অজৈব পদার্থ থেকে জাত হয় তাহলে কোন অংশে এই উল্লম্ফন ঘটল তা জানা চাই। কী সেই মৌলিক কারণ এবং পরিবেশ যা নিষ্প্রাণকে একদিন প্রাণে পরিণত করল? পরবর্তী অধ্যায়ে এ বিষয়টি নিয়ে বিস্তৃতভাবে আলােচনা করা যাবে।