কুদ্দুস ‘লবে’ পড়িয়াছে। তাহার মন উড়ু উড়ু। পড়ালেখায় মন নেই। বই খুললেই কেবল সিমির মুখ ভেসে উঠে। আনমনে গাইতে থাকে আগুনের গান —
ফিজিক্স কেমিস্ট্রিতে মন বসে না
বই খুললেই দেখি তার মুখখানা
অস্থির মন আর বাঁধা মানে না।
একা পথে চললেই পাশে চলে সে
নিবিড় হয়ে সে বলে সে মোরে
ভালোবাসি ভালোবাসি ..।
ক্যামন যেন ঘোরের মধ্যে থাকে কুদ্দুস সর্বক্ষণ। একটা পাখি দেখলে মনে হয় ইস পাখির মতো ডানা মেলে যদি সিমির সাথে উড়ে বেড়ানো যেতো। একটা গোলাপ ফুল দেখলেই মনে হয় আহা যদি সিমির হাতে তুলে দেয়া যেত! রাস্তার পাশে চটপটির গাড়ি দেখলে মনে হয় আহা সিমির সাথে মিলে ফুচকা খাওয়া যেত!
না সিমির সাথে ফুচকা খাওয়া আর কুদ্দুসের হয়ে উঠে না। কারণ সিমি রাস্তার আজেবাজে জিনিস খায় না। সিমি মহা বড়লোকের মেয়ে। বসুন্ধরার আলিশান ফ্ল্যাটে থাকে। পাজেরো জিপে করে ভার্সিটিতে আসে। ড্রাইভার সাহেব দরজা খুলে দেয়, আর সিমি আলতো পায়ে গাড়ি থেকে নেমে সটান হাঁটা দেয় ক্লাসের দিকে। স্টিফেনি মেয়র কিংবা লিসি হ্যারিসনের ইংরেজি উপন্যাসের বই বগলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ‘হাবিজাবি পোলাপাইনরে’ পাত্তাই দেয় না সিমি। মোটের উপর সিমি জানেই না তার জন্য কোনো এক মজনু দিওয়ানা!
আর ওদিকে তো মজনু কুদ্দুসের অবস্থা আসলেই কেরোসিন। সারাক্ষণই ঘোরের মধ্যে থাকে। মনে মনে আকাশ-কুসুম কল্পনা। ভাবে কোনোদিন হয়তো চলতে গিয়ে কিংবা সিঁড়ি ভেঙে নামতে গিয়ে সিমি উষ্টা খেয়ে পড়বে, স্টেফানি মেয়ারের বইগুলো বগল থেকে ছিটকে পড়ে যাবে, আর ঠিক সে সময়ই বীর পুরুষের মতো রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব ঘটবে নায়করাজ কুদ্দুসের। পড়ে যাওয়া বইগুলো কুড়িয়ে নিয়ে সিমির হাতে তুলে দিবে, সিমি প্রথম বারের মতো অবাক নয়নে তাকাবে কুদ্দুসের দিকে, সে দৃষ্টিতে থাকবে আধো কৃতজ্ঞতা, আধো প্রেম, আর আধো রহস্যের ছোঁয়া…
নিশা লাগিলো রে,
বাঁকা দু’ নয়নে নিশা লাগিলো রে …
কিন্তু সাতমন ঘিও পুড়ে না, আর সিমিও উষ্টা খায় না। আর কুদ্দুসের প্রেমের শিকেও ছিঁড়ে না। কিন্তু ছিঁড়ে না ছিঁড়ে না বলেও শেষ পর্যন্ত ছিঁড়লো একদিন। ক্যামনে? ক্যামনে আর, এমনে —
চোখ থাকলেই চোখাচোখি হবে।
হলো!
এখানেই শেষ হতে পারত –
না, প্রেম হয়ে গেল!
তা কুদ্দুস-সিমির প্রেম ক্যামনে হলো, আর তারপর আর কী কী হলো আমরা আর সেখানে এখন না যাই। আমরা বরং চিন্তা করি কুদ্দুসের এই সদা ঘোর লাগা অবস্থার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী? এ নিয়ে রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা নৃতত্ত্ববিদ হেলেন ফিশার এবং স্নায়ুচিকিৎসক লুসি ব্রাউন, আর্থার অ্যারোন প্রমুখ বিজ্ঞানীরা প্রায় ৪০ জন প্রেমে পড়া ছাত্রছাত্রীদের উপর এক গবেষণা চালান[৭২]। তাদের গবেষণার ধরনটি ছিল এরকমের। প্রেমিক-প্রেমিকাদের সামনে তাদের ভালোবাসার মানুষটির ছবি রাখা হলো, এবং তাদের মস্তিষ্কের ফাংশনাল এমআরআই (fMRI) করা হলো।
দেখা গেল, এ সময় তাদের মস্তিষ্কের ভেন্ট্রাল এবং কর্ডেট অংশ উদ্দিপ্ত হচ্ছে, আর সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণে ডোপামিন নামক এক রাসায়নিক পদার্থের নিঃসরণ ঘটছে। অবশ্য কারো দেহে ডোপামিন বেশি পাওয়া গেলেই যে সে প্রেমে পড়েছে তা নাও হতে পারে। আসলে নন-রোমান্টিক অন্যান্য কারণেও কিন্তু ডোপামিনের নিঃসরণ বাড়তে পারে। যেমন, গাঁজা কিংবা কোকেইন সেবন করলে। সেজন্যই আমরা অনেক সময়ই দেখি ভালোবাসায় আক্রান্ত মানুষদের আচরণও অনেকটা কোকেইন সেবী ঘোরলাগা অবস্থার মতোই টালমাটাল হয় অনেক সময়ই।
তবে ভালোবাসার এই রসায়নে কেবল ডোপামিনই নয় সেই সাথে জড়িত থাকে অক্সিটাইসিন, ভেসোপ্রেসিন সহ নানা ধরনের বিতিকিচ্ছিরি নামের কিছু হরমোন। বিজ্ঞানীরা বলেন, এই হরমোনগুলো নাকি ‘ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতে’ মানে প্রেমিক-প্রেমিকার বন্ধন দীর্ঘদিন জোরালো করে রাখতে সহায়তা করে। এমনকি বিজ্ঞানীরা এও বলেন কেউ মনোগামী হবে না বহুগামী হবে তা অনেকটাই কিন্তু নির্ভর করছে এই হরমোনগুলোর তারতম্যের উপর। দেখা গেছে রিসেপটর বা গ্রাহক জিনে ভেসোপ্রেসিন হরমোনের আধিক্য থাকলে তা পুরুষের একগামী মনোবৃত্তিকে ত্বরান্বিত করে।
বিজ্ঞানীরা প্রেইরি ভোলস আর মোন্টেইন ভোলস নামক দুই ধরনের ইঁদুরের উপর গবেষণা চালিয়ে তারা দেখেছেন, একগামিতা এবং বহুগামিতার মতো ব্যাপারগুলো অনেকাংশেই হরমোনের ক্রিয়াশীলতার উপর নির্ভরশীল। এমনকি বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম উপায়ে ভেসোপ্রেসিনের প্রবাহকে আটকে দিয়ে একগামী ইদুঁরকে বহুগামী, কিংবা অতিরিক্ত ভেসোপ্রেসিন প্রবেশ করিয়ে বহুগামী ইঁদুরকে একগামী করে ফেলতে সমর্থ হয়েছেন। তবে ইঁদুরের ক্ষেত্রে যেটা সত্য তার পুরোটুকু মানুষের ক্ষেত্রে সত্য কি না তা নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে। অন্তত বহুগামী লুলপুরুষদের লোলুপতাকে কেবল ইঁদুরের মতো হরমোন চিকিৎসার সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বললে অধিকাংশই দ্বিমত করবেন।
আমরা না হয় কুদ্দুসের প্রেমময় সময়গুলোই বিশ্লেষণে আনি এই মুহূর্তে। কথা হচ্ছে তীব্র প্রেমের সময়গুলোতে কেন দিগ্বিদিকশূন্য নেশার ঘোর লাগা ভাবের উদয় হয়, কেন বুদ্ধিশুদ্ধি একেবারেই লোপ পায়? কেনই বা ভয়ভীতি উবে যায় রাতারাতি? এ সময় বন্ধুদের পরামর্শও মাথায় ঢোকে না। যদি কেউ কুদ্দুসকে বলতো ‘ঐ ব্যাটা কুদ্দুস সিমির পিছে অযথা ঘুইরা লাভ নাই, ওর জগৎ আর তোর জগৎ আলাদা…’ কুদ্দুসের মাথার দেওয়াল সেই তথ্য পৌঁছুবেই না। কিন্তু কেউ যদি আবার উলটো বলে যে, ‘সিমি আজকে তোর সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিল …’ সাথে সাথেই কুদ্দুসের মনে হবে এ যেন ‘মক্কা বিজয়’!
আসলে তীব্র প্রেমের সময়গুলোতে কেন মানুষজনের বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পায় তার একটা ভালো ব্যাখ্যা আছে বিজ্ঞানীদের কাছে। আমাদের মস্তিষ্কে অ্যামিগডালা বলে একটি বাদাম আকৃতির প্রত্যঙ্গ আছে। সেটা এবং মস্তিষ্কের কর্টেক্সের কিছু এলাকা আমাদের ভয়-ভীতি নিয়ন্ত্রণ করে, অকস্মাৎ বিপজ্জনক পরিস্থিতি এলে আমাদের আগাম সতর্ক করে দিতে পারে। দেখা গেছে প্রেমের রোমাঞ্চকর এবং উত্তাল সময়গুলোতে মস্তিকের এ এলাকাগুলোর কাজ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ভয় ভীতি কিংবা ‘ক্রিটিকালি’ চিন্তা করার ব্যাপারস্যাপার গুলো পুরোপুরি লোপ পায় তখন। দুর্মুখেরা বলে, বেশি পরিমাণে গাঁজা-ভাং খেলেও নাকি ঠিক এমনটিই হয়।
ভালোবাসা কারে কয়
৭২.↑ Helen Fisher, What is Love?, On Air, BBC International Magazine 98:12-15