মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে

অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমেদ

০২. ওপারিন-হালডেন তত্ত্বের সত্যতা যাচাই

তত্ত্ব দিলেই তাে হবে না, এর পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ চাই। কিভাবে বােঝা যাবে যে ওপারিনহালডেন সত্যি কথা বলছেন? ওপারিন-হালডেনের তত্ত্বানুযায়ী, আদিম বিজারকীয় পরিবেশে অনেক সরল অজৈব পদার্থ থেকে আপনা-আপনি নানা ধরনের জটিল জৈব পদার্থ তৈরী হয়েছিল। কিন্তু ব্যাপারটা পরীক্ষা করে সত্য-মিথ্যা যাচাই করা খুবই কঠিন। কারণ পৃথিবী তাে আর আদিম পরিবেশে চুপটি করে বসে নেই। এর পরিবেশ ইতিমধ্যেই বদলে গেছে বিস্তর।

এ পরিবর্তিত পরিবেশে তাে পরীক্ষা করে সত্য-মিথ্যা যাচাই করার কোন মানে হয় না। তাহলে দরকার একটা কৃত্রিম পরিবেশের। কোনভাবে যদি এই কৃত্রিম আদিম পরিবেশ তৈরী করে দেখানাে যায় যে, পৃথিবীর আদিতে যে সমস্ত গ্যাস প্রকৃতিতে বিদ্যমান ছিল এবং তখন যে সমস্ত শক্তি আর বিকিরণ সক্রিয় ছিল, তাদের প্রভাবে অ্যামাইনাে এসিড, বিভিন্ন সরল শর্করা, জৈব এসিড আর তার বেসসমূহ তৈরী হতে পারে, তাহলেই জীবনের রাসায়নিক উৎপত্তি সংক্রান্ত অনুকল্পটির পক্ষে জোরালাে যুক্তি পাওয়া যাবে।

শিকাগাে বিশ্ববিদালয়ের নােবেল পুরস্কার বিজয়ী রসায়নবিদ হ্যারলড সি, ইউরে (Harld C. Urey) তাঁর গ্রাজুয়েট ছাত্র স্টেনলি এল. মিলার (Sanley L. Miller) কে ওপারিনের রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জীবন উদ্ভবের অনুকল্পটি সঠিক কিনা যাচাই করে দেখতে বললেন। মিলার ১৯৫৩ সালে একটি বায়ু নিরােধক কাঁচের ফ্লাস্কে আদি পৃথিবীর পরিবেশের একটা নকল দশা তৈরী করেন, অনেকটা প্রদত্ত ছবির মত (চিত্র ৪.৩ ক)।

তিনি আগেই পাম্প করে এর ভিতর থেকে বাতাস বের করে নেন। তারপর সংযুক্ত ফ্লাস্কের পানি ফুটিয়ে জলীয় বাষ্প তৈরী করেন। একটি বড় পাঁচ লিটার ফ্লাস্কে হাইড্রোজেন, মিথেন ও অ্যামােনিয়া গ্যাস প্রবেশ করান। সেখানে ওই আগের ফুটন্ত জলীয় বাষ্প এসে মিশে যায়। এবার তিনি মিশ্রণে বৈদ্যুতিক প্রবাহ চালু করেন। বিক্রিয়াজাত গ্যাসগুলােকে শীতকের সাহায্যে ঘনীভূত করা হয়, এবং তারপর সেগুলাে বিশ্লেষণ করা হয়।

লক্ষ্যনীয় যে, প্রকৃতিতে প্রাপ্ত ২০টি অ্যামাইনাে এসিডের মধ্যে প্রথম পরীক্ষাতেই ৯ টি অ্যামাইনাে এসিড পাওয়া যায়। এগুলাে হচ্ছে (১) গ্লাইসিন, (২)এলানি, (৩) আলফাঅ্যামাইনােবুট্রায়িক এসিড, (8) আলফা- অ্যামাইনােসােবুট্রায়িক এসিড, (৫) বিটা-এলানি, (৬) এম্পারটিক এসিড, (৭) গ্লুটামিক এসিড, (৮) সারকোসিন, এবং (৯) এন-মিথাইল এলানিন। এছাড়াও তৈরী হয় এলডিহাইড ও কিটোন। এই দুটি উপাদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলাে জাড়িত হয়ে পরে জৈব এসিড তৈরী করতে পারে।

ওপারিন-হালডেন তত্ত্বের
চিত্র ৪.৩: (ক) মিলার ও ইউরের বিখ্যাত পরীক্ষা : আদিম বিজারকীয় পরিবেশে বৈদ্যুতিক প্রবাহের মাধ্যমে জৈব বস্তু উৎপাদন (খ) মিলার ও ওর্গেল প্রমুখের পরীক্ষায় উৎপন্ন ১৮ টি জৈব এসিড

উৎপন্ন এমিনাে এসিড গুলাের মধ্যে প্রাচুর্য আর গুরুত্বের দিক দিয়ে গ্লাইসিন নিঃসন্দেহে থাকবে এক নম্বরে। গ্লাইসিন তৈরী হয় ফরমালডিহাইড, অ্যামােনিয়া আর হাইডােজেন সায়ানাইডের সমন্বয়ে। মিলারের পরীক্ষায় গ্লাইসিন কিভাবে তৈরী হয় তা নীচের ছবিতে (চিত্র 8.8) দেখানাে হয়েছে।

glycine
চিত্র ৪.৪: মিলারের পরীক্ষায় কিভাবে গ্লাইসিন উৎপন্ন হয় তা দেখানাে হয়েছে।

পরবর্তী সময়ে মিলার ও ইউরে (১৯৫৫), মিলার ও ওর্গেল (১৯৭৪), মিলার (১৯৮৭) একই পদ্ধতিতে ২০টির মধ্যে ১৮টি জৈব এসিড এভাবে তৈরী করেছিলেন। তাদের পরীক্ষাই সর্বপ্রথম প্রমাণ করে ওপারিনের অনুকল্প সঠিক; অর্থাৎ, আদিম বিজারকিয় পরিবেশে সত্যই অজৈব পদার্থ থেকে জৈব পদার্থের উন্মেষ ঘটেছিল। এ আবিষ্কারের জন্য ইউরে (দ্বিতীয়বার) এবং মিলার নােবেল পুরস্কার লাভ করেন।

stanley-miller-and-harold-urey
চিত্র ৪.৫: গবেষণাগারে গবেষণারত স্ট্যানলি এল. মিলার (১৯৫৩ সালে তোলা ছবি)

মিলার-ইউরের কাজের কথা প্রচারিত হবার পর পরই সারা দুনিয়া জুড়ে এ ধরনের কাজের হিড়িক পড়ে যায় একেবারে। অনেকেই নানা রকম দ্রব্য মিশিয়ে বিজারকীয় পরিবেশে অজৈব বস্তু থেকে জৈব বস্তু পাওয়া যায় কিনা দেখতে শুরু করেন। এর মধ্যে পাবলােবস্কায়া ও পেসিসিস্কি (১৯৫৯), ফিলিপ এবেলসন (১৯৫৭), অরাে (১৯৬৩), গ্রাসেনবেখার ও নাইট (১৯৬৫), ডােজ ও রাজেউস্কি। (১৯৫৭), হারাডা ও ফক্স (১৯৬৯), গ্রথ ও ওয়েনসেফ (১৯৫৯) প্রমুখের পরীক্ষাগুলাে উল্লেখযােগ্য। সবাই কিন্তু মিলার-ইউরের মতই ফলাফল পেয়েছিলেন। আর এখন তাে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডার গ্রাজুয়েট রসায়ন কোর্সেই ছাত্ররা সাফল্যের সাথে মিলার-ইউরের বিখ্যাত পরীক্ষাটির পুনরাবৃত্তি করতে পারে।

শুধু ল্যাবরেটরীর পরীক্ষাগুলােই যে ওপারিন হাইডেল তত্ত্বের একমাত্র প্রমাণ তা কিন্তু নয়। জ্যোতির্বিদ্যা আর ভুতত্ত্ববিদ্যার বহু সাক্ষ্যই এখন এই তত্ত্বের অনুকূলে। মহাকাশের অনেক তারা, ধুলি মেঘ, মহাশূন্য ও আবহাওয়ামন্ডলে অজৈব পদার্থের অণু থেকে জৈব মনােমার (Organic monomers) গঠনের বহু প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। ইউরােপীয় মহাকাশ এজেন্সির গিয়ােটো মহাশূন্যযান (Giotto spacecraft) ১৯৮৬ সালে হ্যালির ধূমকেতুর অভ্যন্তরে চিনি, অ্যালডিহাইড, অ্যালকোহল, এবং এসিডের সমন্বয়ে গঠিত ফরমালডিহাইডের পলিমারের সন্ধান পায়।

আবার আকাশ থেকে পড়া অনেক উল্কাপিন্ডেই সময় সময় নানা ধরনের জটিল জৈব যৌগের সন্ধান পাওয়া যায়। চাঁদ থেকে নিয়ে আসা শিলাখন্ডেও খুব সামান্য পরিমানে হলেও ছয়টি পরিচিত সাধারণ এমিনাে এসিডের খোঁজ পাওয়া গেছে। এমনকি এই পৃথিবী পৃষ্ঠেই দেখা গেছে নির্বাত প্রক্রিয়ায় (Abiotically) আগ্নেয়গিরির গ্যাসের মধ্যকার ধাতব কার্বাইড আর উত্তপ্ত গলিত লাভা পানির সাথে বিক্রিয়া করে হাইড্রোকার্বন তৈরী করছে।

উপরের উদাহরণগুলাের সবগুলােই আদিম পরিবেশে অজৈব পদার্থ থেকে জৈবপদার্থের উদ্ভবের সম্ভাবনাটিকে অত্যন্ত শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। রসায়ান চর্চার প্রথম দিকে মানুষের ধারণা ছিল জৈব পদার্থ এবং অজৈব পদার্থ একেবারেই আলাদা দুটি জিনিস – এদের বৈশিষ্ট্য একদম আলাদা। তারা ভাবতেন জৈব পদার্থ এক অর্থে অনন্য; কারণ জৈব পদার্থের মধ্যে লুকিয়ে আছে জীবনদায়ী শক্তি (Life force)[ভ্রমাত্মক Life force বা জীবনদায়ীশক্তি নিয়ে প্রথম অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হয়েছে।] যা কোন অজৈব পদার্থে নেই।

জীবদেহ গঠিত হয় জৈব পদার্থ দিয়ে, তাই এতে রয়েছে প্রাণশক্তির স্ফুরণ; আর অন্যদিকে জড় জগৎ তৈরী হয়েছে অজৈব পদার্থ দিয়ে – তাই তারা প্রাণহীন ও নিথর। জৈব পদার্থের আনন্যতার ধারণাটি মানুষের মনে এতটাই স্থায়ী আসন গেড়ে গিয়েছিল, এর ভুত এখনও আমাদের কাঁধ থেকে নামে নি। এখনও আমাদের পাঠ্য বইগুলােতে ‘জৈব রসায়ন আর ‘অজৈব রসায়ন’ – আলাদা দু ভাগে ভাগ করে ছাত্রদের রসায়ন পড়ানাে হয়ে থাকে। কিন্তু এই সজ্ঞাত ধারণাটি হঠাৎ ধাক্কা খেল ১৮২০ সালে এসে যখন বিজ্ঞানী ভােয়েলার (Wohler) তাপ প্রয়ােগে অজৈব এমােনিয়াম সায়ানেট থেকে ইউরিয়া নামক জৈব পদার্থ উৎপন্ন করলেন:

amonium

এইভাবে কৃত্রিম উপায়ে ইউরিয়া আবিস্কার করে ভােয়েলার তার শিক্ষক বার্জিলিয়াসকে চিঠি লিখে জানান : ‘প্রাণীর বৃক্ক ছাড়াই আমি ইউরিয়া তৈরী করতে সক্ষম হয়েছি’। এরপর আরেক বিজ্ঞানী কোলবি (Kolbe) অজৈব মৌল থেকে অ্যাসিটিক এসিড তৈরী করতে সক্ষম হন। এই সমস্ত আবিস্কারের ফলে জৈব- আজৈবের মাত্রাগত পার্থক্যটুকু ঘুচে গেল। যারা জৈবপদার্থকে প্রথম থেকেই ‘অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ’ একটা কিছু বলে ভেবে নিয়েছিলেন, মনে করেছিলেন জীবনশক্তির (Life force) সাহায্য ছাড়া কখনাে জৈব পদার্থ তৈরী করা সম্ভব নয়, তাদের বিশ্বাস কিন্তু টলে গেল। এখন তাে বিজ্ঞানীরা রসায়নগারে শত শত জৈব পদার্থ কৃত্রিম উপায়ে তৈরী করতে সক্ষম।

বিজ্ঞানীরা আরও দেখেছেন যে, আমাদের দেহের কার্বন অণুর সাথে ওই মালবাহী ট্রাকটির সায়লেন্সার পাইপের মধ্যে দিয়ে বেরুনাে ময়লা কার্বন মনােক্সাইড গ্যাসের ভিতর লুকিয়ে থাকা কার্বন অণুর আসলে কোনই পার্থক্য নেই। কোন জাদুকরের কেরামতিতে অজৈব পদার্থের প্রাণহীন কদাকার কার্বন অণুগুলাে জৈব পদার্থে গিয়ে ‘সজীব হয়ে উঠছে না’; কোন অলৌকিক জীবনদায়ী শক্তি উষর, বন্ধ্যা কার্বন অণুগুলােকে বদলে দিয়ে (জৈব পদার্থের ভিতর) এগুলােকে প্রাণে প্রাণে পুষ্পিত করে তুলে না।

শুধু কার্বন নয়- সেই সাথে হাইড্রোজেন (H), অক্সিজেন (O) এবং নাইট্রোজেন (N), যেগুলােকে একসাথে আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে CHON নামে চিনেছি সেগুলােও কিন্তু অজৈব পদার্থ থেকে জৈব পদার্থে আসার জন্য কোন বিশেষ ‘ওহী’ প্রাপ্ত হয় না। এদের চেহারা আর বৈশিষ্ট্য কিন্তু একই রকমই থেকে যায়। তাই বিজ্ঞানীরা মনে করেন, জৈব যৌগের উদ্ভব কোন রহস্যময় কারণে নয়, বরং তারা মনে করেন, সুদূর অতীতে নানারকম  প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবেই অজৈব পদার্থ থেকে জৈব পদার্থের সৃষ্টি হয়েছিলাে, যা ১৯৫৩ সালে ইউরে-মিলারের পরীক্ষায় অত্যন্ত সার্থকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, সে সব আদিম জৈব উপাদান থেকেই কালের পরিক্রমায় গড়ে উঠেছিল প্রথম জীব। আগামী অধ্যায়ে জীবনের উৎপত্তির পেছনে রাসায়নিক বিবর্তনের ধাপগুলাে নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হবে ।


 মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে

শেয়ার করুন —
5 1 vote
Post Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
মন্তব্য করুনx
()
x
Scroll to Top
Scroll to Top
১ম অধ্যায়

২য় অধ্যায়

৩য় অধ্যায়

৪র্থ অধ্যায়

৫ম অধ্যায়

৬ষ্ঠ অধ্যায়

৭ম অধ্যায়

৮ম অধ্যায়

৯ম অধ্যায়

গ্রন্থ আলোচনা/সমালোচনা