মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে

অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমেদ

০১. আছে জন্ম, আছে মৃত্যু, আছে প্রাণ

প্রাণ বা জীবন কি (What is life?)- এ প্রশ্নটি মানব মনের সব চাইতে পুরাতন অথচ কৌতুহলােদ্দীপক প্রশ্নগুলাের একটি। এ প্রশ্নটির ব্যঞ্জনায় যুগে যুগে আলােড়িত হয়েছে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সাহিত্যিক, কবি, গীতিকার, দার্শনিক, বৈরাগী সকলেই। গীতিকারেরা গান রচনা করেছেন – জীবন – সে তাে পদ্মপাতায় শিশির বিন্দু। কবি তার কল্পণার মায়াজাল বুনে লিখেছেন- Life is nothing but an empty dream। বৈরাগী হয়ত মারফতি করে বলেছেন – জীবনটা তাে মায়া ছাড়া আর কিছু নয়। আসলে জীবনটা যে সত্যিই কি – এ প্রশ্নের উত্তর দার্শনিক-অদার্শনিক, পণ্ডিত-মূর্খ কারাে কাছেই খুব সঠিকভাবে বােধ হয় পাওয়া যাবে না।

বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে জীবন বা প্রাণ কি এটা জানতে হলে ‘জীবন কি নয় এটা বােধ হয় আগে ভালভাবে জানা দরকার। জীবজগৎ আর জড়জগৎ – এ নিয়েই আমাদের চিরচেনা বিশ্বজগৎ। প্রাণের নিশ্চয়ই এমন কোন নান্দনিক বিশিষ্টতা আছে যা জড় পদার্থ থেকে আলাদা। আর সে কারণেই অ্যামিবা, পুঁটিমাছ, কঁচু শাক, হাতি, তিমি, ইঁদুর বা মানুষদের সহজেই ইট, কাঠ, লােহা, পাথর থেকে আলাদা করা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কী সেই নান্দনিক বিশিষ্টতা?

প্রাচীনকালের মানুষেরা যে এ সমস্যা নিয়ে ভাবেনি তা নয়। জীবিতদের কিভাবে সনাক্ত করা যায়? একটি মৃতদেহ আর একটি জীবিত দেহের মধ্যে পার্থক্যই বা কী? এ প্রশ্নগুলাে দিয়ে তাদের অনুসন্ধিৎসু মন সব সময়ই আন্দোলিত হয়েছে পুরােমাত্রায়। কিন্তু এই প্রশ্নগুলাের কোন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না পেয়ে তারা শেষপর্যন্ত কল্পনা করে নিয়েছে অদৃশ্য আত্মার। ভেবেছে আত্মাই বুঝি জীবন ও মৃত্যুর যােগসূত্র। কল্পনার ফানুস উড়িয়ে তারা ভেবেছে ঈশ্বরের নির্দেশে আজরাইল বা যমদূত এসে প্রাণহরণ করলেই কেবল একটি মানুষ মারা যায়। আর তখন তার দেহস্থিত আত্মা পাড়ি জমায় পরলােকে।

মৃত্যু নিয়ে মানুষের এ ধরনের ভাববাদী চিন্তা জন্ম দিয়েছে অধ্যাত্মবাদের। আধ্যাত্মবাদ স্বতঃ প্রমাণ হিসেবেই ধরে নেয়- আত্মা জন্মহীন, নিত্য, অক্ষয়। শরীর হত হলেও আত্ম হত হয় না। মজার ব্যাপার হল, একদিকে যেমন আত্মাকে অমর অক্ষয় বলা হচ্ছে, জোর গলায় প্রচার করা হচ্ছে। আত্মাকে কাটা যায় না, পােড়ানাে যায় না, আবার সেই আত্মাকেই পাপের শাস্তিস্বরূপ নরকে ধারালাে অস্ত্র দিয়ে কাটা, গরম তেলে পােড়ানাের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ সবই আধ্যাত্মবাদের স্ববিরােধিতা। ধর্মগ্রন্থগুলি ঘাটলেই এ ধরনের স্ববিরােধিতার হাজারাে দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। স্ববিরােধিতা থাকা সত্ত্বেও আত্মার অস্তিত্ব দিয়ে জীবনকে ব্যাখ্যা করতে প্রয়াসী হয়েছে মানুষ।

কারণ সে সময় বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ছিল সীমিত। মৃত্যুর সঠিক কারণ ছিল তাদের জানার বাইরে। সেজন্য অনেক ধর্মবাদীরাই ‘আত্মা’ কিংবা ‘মন’-কে জীবনের আধাররূপী বস্তু হিসেবে কল্পনা করেছেন। যেমন, ইসলামিক মিথ বলছে, আল্লাহ মানবজাতির সকল আত্মা একটি নির্দিষ্ট দিনে তৈরী করে বেহেস্তে একটি নির্দিষ্ট স্থানে (ইল্লিন) বন্দি করে রেখে দিয়েছেন। আল্লাহর ইচ্ছাতেই নতুন নতুন প্রাণ সঞ্চারের জন্য একেকটি আত্মাকে তুলে নিয়ে মর্তে পাঠানাে হয়। আবার আচার্য শঙ্কর তার ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে  বলেছেন,  মন হল আত্মার উপাধি স্বরূপ। ওদিকে আবার সাংখ্যদর্শনের মতে – আত্মা চৈতন্যস্বরূপ (সাংখ্যসুত্র ৫/৬৯)। জৈন দর্শনে বলা হয়েছে, চৈতন্যই জীবের লক্ষণ বা আত্মার ধর্ম (ষড়দর্শন সমুচ্চয়, পৃঃ ৫০)। স্বামী বিবেকানন্দ পর্যন্ত ভাবতেন, চৈতন্য বা চেতনাই আত্মা (বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র, পৃঃ ১৬২)। স্বামী অভেদানন্দের মতে, আত্মা বা মন মস্তিস্ক বহির্ভুত পদার্থ, মস্তিষ্কজাত নয় (মরণের পারে, পঃ ৯৮)।

গ্রীক দর্শনেও আমরা প্রায় একই রকম ভাববাদী দর্শনের ছায়া দেখতে পাই। প্লেটোর বক্তব্য ছিল যে, প্রাণী বা উদ্ভিদ কেউ জীবিত নয়, কেবলমাত্র যখন আত্মা প্রাণী বা উদ্ভিদদেহে প্রবেশ করে তখনই তাতে জীবনের লক্ষণ পরিস্ফূট হয়। সব ধর্মমতই প্রচলিত এই ধারণার সাথে সঙ্গতি বিধান করে। প্লেটোর এই তত্ত্ব অ্যারিস্টটলের দর্শনের রূপ নিয়ে প্রায় দু-হাজার বছর রাজত্ব করে। অ্যারিস্টটলের পরবর্তী গ্রীক ও রােমান দার্শনিকেরা অ্যারিস্টটলীয় দর্শনকে প্রসারিত করে পরবর্তী যুগের চাহিদার উপযােগী করে তােলেন। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে নয়া প্লেটোবাদীরা ঈশ্বর অজৈব বস্তুর মধ্যে জীবন সৃষ্টিকারী আত্ম প্রবেশ করিয়ে দিয়ে তাকে জীবন দান করেন – এই মত প্রচার করতে শুরু করেন।

নয়া প্লেটোবাদী প্লাটিনাসের মতে, জীবনদায়ী শক্তিই জীবনের মূল। বস্তুতপক্ষে, জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ‘জীবনশক্তি (Life force) তত্ত্ব এখান থেকেই যাত্রা শুরু। করে এবং জীবনের উৎপত্তি প্রসঙ্গে ভাববাদী দর্শনের ভিত্তিও জোরালাে হয়। ধর্মবাদী চিন্তা, বৈজ্ঞানিক অনগ্রসরতা, কুসংস্কার, ভয় সব কিছু মিলে শিক্ষিত সমাজে এই ভাববাদী চিন্তাধারার দ্রুত প্রসার ঘটে।

sanidar cave
চিত্র ১.১: (ক) নিয়ান্ডার্থালদের মৃতদেহ কবর দেয়ার সময় পারলৌকিক আচার আচরণ। (খ) শনিদার গুহায় পাওয়া ফসিলের অবশেষ।

আসলে আত্মার অস্তিত্বের ব্যাপারটি মানুষের মৃত্যুভয়ের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত তাই তা জনমানসে রাজত্ব করেছে দীর্ঘকাল। এখন পর্যন্ত জানা তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, আত্মা দিয়ে জীবন মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করার করার প্রচেষ্টা প্রথম শুরু হয়েছিলাে নিয়ান্ডার্থাল মানুষের আমলে – যারা পৃথিবীতে রাজত্ব করেছে এখন থেকে প্রায় আড়াই লক্ষ বছর আগে। নিয়ানডার্থাল মানুষের আগে পিথেকানথ্রোপাস আর সিনানথ্রোপাসদের মধ্যে এ ধরনের ধর্মাচরণের কোন নিদর্শন পাওয়া যায় নি। তবে নিয়ান্ডার্থাল মানুষের বিশ্বাসগুলাে ছিল একেবারেই আদিম- আজকের দিনের প্রচলিত ধর্মমতগুলাের তুলনায় অনেক সরল।

ইরাকের শানিদার নামের একটি গুহায় নিয়ান্ডার্থাল মানুষের বেশ কিছু ফসিল পাওয়া গেছে যা দেখে অনুমান করা যায় যে, নিয়ান্ডার্থালরা প্রিয়জন মারা গেলে তার আত্মার উদ্দেশ্যে ফুল নিবেদন করতাে। এমনকি তারা মৃতদেহ কবর দেয়ার সময় এর সাথে পুষ্পরেণু, খাদ্যদ্রব্য, অস্ত্র সামগ্রী, শিয়ালের দাঁত এমনকি মাদুলীসহ সব কিছুই দিয়ে দিত যাতে পরপারে তাদের আত্মা শান্তিতে থাকতে পারে আর সঙ্গে আনা জিনিসগুলাে ব্যবহার করতে পারে।

বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি আর যুক্তির প্রসারের ফলে আজ কিন্তু আত্মা দিয়ে জীবন-মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করার অন্তর্নিহিত ত্রুটিগুলাে মানুষের চোখে সহজেই ধরা পড়ছে। যদি জীবনকে ‘আত্মার উপস্থিতি’ আর মৃত্যুকে ‘আত্মার দেহত্যাগ’ দিয়েই ব্যাখ্যা করা হয়, তবে তাে যে কোন জীবিত সত্ত্বারই – তা সে উদ্ভিদই হােক আর প্রাণীই হােক- আত্মা থাকা উচিৎ। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে একটি দেহে কি কেবল একটিমাত্র আত্মা থাকবে নাকি একাধিক? যেমন, বেশ কিছু উদ্ভিদ – গােলাপ, কলা, ঘাসফুল এমন কি হাইড্রা, কোরালের মত প্রাণীরাও কর্তন (Cut) ও অঙ্কুরােদগমের (Bud) মাধ্যমে বিস্তৃত হয়। তাহলে কি সাথে সাথে আত্মাও কর্তিত হয়, নাকি একাধিক আত্মা সাথে সাথেই অঙ্কুরিত হয়? আবার মাঝে মধ্যেই দেখা যায় যে, পানিতে ডুবে যাওয়া, শ্বাসরুদ্ধ, মৃত বলে মনে হওয়া/ঘােষিত হওয়া অচেতন ব্যক্তির জ্ঞান চিকিৎসার মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত মােটেও বিরল নয় – তখন কি দেহত্যাগী বৈরাগী আত্মাকেও সেইসাথে ডেকে ঘরে থুড়ি দেহে ফিরিয়ে আনা হয়?

প্রজননকালে পিতৃদত্ত শুক্রানু আর মাতৃদত্ত ডিম্বাণুর মিলনে শিশুর দেহকোষ তৈরী হয়। শুক্রানু আর ডিম্বানু জীবনের মূল, তাহলে নিশ্চয় তাদের আত্মাও আছে। এদের আত্মা কি তাদের আভিভাবকদের আত্মা থেকে আলাদা? যদি তাই হয় তবে কিভাবে দুটি পৃথক আত্মা পরস্পর মিলিত হয়ে শিশুর দেহে একটি সম্পূর্ণ নতুন আত্মার জন্ম দিতে পারে? মানব মনের এ ধরনের অসংখ্য যৌক্তিক প্রশ্ন আত্মার অসারত্বকেই ধীরে ধীরে উন্মােচিত করেছে।

আর ভাববাদীরা যাই বলুক না কেন স্কুলের পাঠ শেষ করা ছাত্রটিও আজ জানে, মন কোন ‘বস্তু’ নয়; বরং মানুষের মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের কাজ কর্মের ফল। চোখের কাজ যেমন দেখা, কানের কাজ যেমন শ্রবণ করা, পাকস্থলীর কাজ যেমন খাদ্য হজম করা, তেমনি মস্তিস্ক কোষের কাজ হল চিন্তা করা। তাই নােবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিক তাঁর ‘The Astonishing Hypothesis: The Scientific Search for the Soul’ গ্রন্থে পরিস্কার করেই বলেন:

বিস্ময়কর অনুকল্পটি হল: আমার  আমিত্ব, আমার উচ্ছ্বাস, বেদনা, সুতি, আকাংখা, আমার সংবেদনশীলতা, আমার পরিচয় এবং আমার মুক্তবুদ্ধি এগুলাে আসলে। মস্তিস্কের স্নায়ুকোষ এবং তাদের আনুষঙ্গিক অণুগুলাের বিবিধ ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই নয়।

মানুষ চিন্তা করতে পারে বলেই নিজের ব্যক্তিত্বকে নিজের মত করে সাজাতে পারে, সত্য-মিথ্যের মিশেল দিয়ে কল্পনা করতে পারে তার ভিতরে ‘মন’ বলে সত্যই কোন পদার্থ আছে, অথবা আছে অদৃশ্য কোন আত্মার আশরীরী উপস্থিতি। মৃত্যুর পর দেহ বিলীন হয়। বিলীন হয় দেহাংশ, মস্তিস্ক স্নায়ুকোষ। আসলে মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের মৃত্যু মানেই কিন্তু ‘মন’ এর মৃত্যু, সেই সাথে মৃত্যু তথাকথিত আত্মার। অনেক সময় দেখা যায় দেহের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ঠিকমত কর্মক্ষম আছে, কিন্তু মস্তিষ্কের কার্যকারিতা হারিয়ে গেছে। এ ধরনের অবস্থাকে বলে কোমা। মানুষের চেতনা তখন লুপ্ত হয়। মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা হারানাের ফলে জীবিত দেহ তখন অনেকটা জড়পদার্থের মতই আচরণ করে। তাহলে জীবন ও মৃত্যুর যােগসূত্রটি রক্ষা করছে কে? এ কি অশরীরী আত্মা, নাকি মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের সঠিক কর্মক্ষমতা?

এ পর্যায়ে বিখ্যাত ক্রিকেটার রমণ লাম্বার মৃত্যুর ঘটনাটি স্মরণ করা যাক। ১৯৯৮ সালের ২০ এ ফেব্রুয়ারী ঢাকা স্টেডিয়ামে (বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) লীগের খেলা চলাকালীন সময় মেহেরাব হােসেন অপির একটি পুল শট ফরওয়ার্ড শর্ট লেগে ফিল্ডিংরত লাম্বার মাথায় সজোরে আঘাত করে। প্রথমে মনে হয়েছিল তেমন কিছুই হয় নি। নিজেই হেঁটে প্যাভিলিয়নে ফিরলেন; কিন্তু অল্প কিছুক্ষণ পরই জ্ঞান হারালেন তিনি। চিকিৎসকেরা তাকে ক্লিনিকে ভর্তি করলেন। পরদিন ২১ এ ফেব্রুয়ারী তাকে পিজি হাসপাতালের নিউরােসার্জারি বিভাগে ভর্তি করা হল। সেখানে তার অপারেশন হল, কিন্তু অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকেই যাচ্ছিল। পরদিন ২২ এ ফেব্রুয়ারী ডাক্তাররা ঘােষণা করলেন যে, মস্তিষ্ক তার কার্যকারিতা হারিয়েছে। হার্ট-লাং মেশিনের সাহায্যে কত্রিমভাবে হৎপিন্ড এবং ফুসফুসের কাজ চলছিল।

০১. আছে জন্ম, আছে মৃত্যু, আছে প্রাণ
চিত্র ১.২: রমন লাম্বা : মেধাবী ক্রিকেটারের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু

২৩ ফেব্রুয়ারী বিকেল সাড়ে তিনটায় তার আইরিশ স্ত্রী কিমের উপস্থিতিতে হার্ট লাং মেশিন বন্ধ করে দিলেন চিকৎসকেরা। থেমে গেল লাম্বার হৃৎস্পন্দন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর তারিখ কোনটি হওয়া উচিৎ? ২২ নাকি ২৩ ফেব্রুয়ারী? আর তার মৃত্যুক্ষণটি নির্ধারণ করলেন কারা? আজরাইল/যমদুত নাকি চিকিৎসারত ডাক্তারেরা?

এ ব্যাপারটি আরও ভালভাবে বুঝতে হলে মৃত্যু নিয়ে দু’চার কথা বলতেই হবে। জীবনের অনিবর্তনীয় পরিসমাপ্তিকে (Irreversible cessation of life) বলে মৃত্যু। কেন জীবের মৃত্যু হয়? কারণ আমরা (উদ্ভিদ এবং প্রাণী) উত্তরাধিকার সূত্রে বিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের পূর্বপুরুষদের যারা যৌনসংযােগের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে প্রকৃতিতে টিকে রয়েছে তাদের থেকে মরণ জিন (Death Gene) প্রাপ্ত হয়েছি এবং বহন করে চলেছি। এই ধরনের জিন। (Death Gene) তার পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পিত উপায়েই মৃত্যুকে তুরান্বিত করে চলেছে। যৌনজননের মাধ্যমে বংশবিস্তাররের ব্যাপারটিতে আমি এখানে গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ, যে সমস্ত প্রজাতি যৌনজননকে বংশবিস্তারের একটি মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে, তাদের ‘মৃত্যু’ নামক ব্যাপারটিকেও তার জীবগত বৈশিষ্ট হিসেবে গ্রহণ করে নিতে হয়েছে। দেখা গেছে স্তন্যপায়ী জীবের ক্ষেত্রে সেক্স-সেল বা যৌনকোষগুলােই (জীববিজ্ঞানীরা বলেন জার্মপ্লাজম) হচ্ছে একমাত্র কোষ যারা সরাসরি এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে নিজেদের জিন সঞ্চারিত করে টিকে থাকে।

সে তুলনায় দেহকোষগুলাে হয় স্বল্পায়ুর। অনেকে এই ব্যাপারটির নামকরণ করেছেন প্রােগ্রামড ডেথ। এক প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী হালকাচালে তার একটি লেখায় বলেছেন, মৃত্যুও বােধহয় সিফিলিস বা গনােরিয়ার মত একধরনের Sexually Transmitted Disease’ যা আমরা বংশ পরম্পরায় সৃষ্টির শুরু থেকে বহন করে চলেছি! ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার মত সরল কোষী জীব যারা যৌন জনন নয়, বরং কোষ বিভাজনের মাধ্যমে প্রকৃতিতে টিকে আছে তারা কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই অমর। এদের দেহ কোষ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে বিভাজিত হয়, তার পর বিজিত অংশগুলিও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে পুনরায় বিভাজিত হয়; কোন অংশই আসলে সেতারে মৃত্যুবরণ করে না। কাজেই দেখা যাচ্ছে মৃত্যু ব্যাপারটি সব জীবের জন্যই অত্যাবশ্যকীয় নিয়ামক নয়। তবে মানুষের নিজের প্রয়ােজনে রাসায়নিক জীবাণুনাশক ঔষধপত্রাদির উদ্ভাবন ও তার প্রয়ােগে জীবাণুনাশের ব্যাপারটি এক্ষেত্রে আলাদা।

আসলে মানুষের মত বহুকোষী উচ্চশ্রেনীর প্রাণীদের মৃত্যু দু ধরনের। দেহের মৃত্যু (Clinical Death) এবং কোষীয় মৃত্যু (Cellular Death)। দেহের মৃত্যুর স্বল্প সময় পরেই কোষের মৃত্যু ঘটে। মানব দেহের তিনটি গুরুত্বপুর্ণ অঙ্গ রয়েছে – মস্তিষ্ক, হৃৎপিন্ড, আর ফুসফুস। যে কোন একটির বা সবগুলাের কার্যকারিতা নষ্ট হলে মৃত্যু হতে পারে। যেমন, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বন্ধ হলে কোমা হয়, রমণ লাম্বার ক্ষেত্রে যেটি ঘটেছে; হৃৎপিন্ডের কার্যকারিতা বন্ধ হওয়াকে বলে সিনকোপ, ফুসফুসের কার্যকারিতা বন্ধ হওয়াকে বলে আসফিক্সিয়া। ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেও কিন্তু মৃত্যু ব্যাপারটার সংজ্ঞা দেওয়া এতােটা কঠিন ছিলাে না। খুব সহজ সংজ্ঞা। হৃৎস্পন্দন থেমে যাওয়ার সাথে সাথেই কিংবা ফুসফুস তার হাপরের উঠানামা বন্ধ করে দেওয়ার সাথে সাথেই ব্যক্তির জীবন-প্রদীপ নির্বাপিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হত।

কিন্তু ১৯৬৮ সালে হৃৎসংস্থাপন (Heart Transplant) প্রক্রিয়ার আবিস্কার এবং এ সংক্রান্ত প্রযুক্তির উন্নয়নের পর মৃত্যুর এই সংজ্ঞা কিন্তু বদলে যায়। কিভাবে এখন হলফ করে সেই ‘হৃদয়দাতা’কে মৃত বলা যাবে যখন চোখের সামনেই তার হৃদয় অন্যের দেহে স্পন্দিত হয়ে চলেছে? চিকিৎসা বিজ্ঞান পুরাে ব্যাপারটিকে আরাে জটিল করে ফেললাে শ্বাসযন্ত্র বা রেস্পিরেটর আবিষ্কার করে- যেটি হৃৎপিন্ড আর ফুসফুসকে কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আধুনিক কোন কবি কিন্তু এখন মৃত্যু নিয়ে কবিতা লিখতেই পারেন এই বলে যে – ‘হে হিমশীতল মৃত্যু – তুমি হচ্ছ রেস্পিরেটর সুইচের সহসা নির্বাপন!

যত দিন যাচ্ছে ততই কিন্তু কৃত্রিম উপায়ে জীবন আয়ু ত্বরান্বিত করার ব্যাপারটি খুব সাধারণ একটি বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে অনেক মৃত্যুপথ যাত্রী অসুস্থ রােগীর মৃত্যু নানাভাবে বিলম্বিত করা গেছে – কারাে কারাে জন্য কম সময়ের জন্য, আবার কারাে জন্য দীর্ঘ সময়ের জন্য। যেমন ধরুন বার্নি ক্লার্ক নামের এক ডেনটিস্ট ভদ্রলােকের উদাহরণ, যিনি ১৯৮২ সালে নিজের রােগাক্রান্ত হৃৎপিন্ডের পরিবর্তে একটি যান্ত্রিক হৃদয় নিয়ে বেঁচে ছিলেন কয়েক মাস যাবৎ। আবার ১৯৮৪ সালে সদ্যজন্মলাভ করা শিশু ফে কে অতিরিক্ত ২০দিন বাঁচিয়ে রাখা গিয়েছিলাে একটি বেবুনের হৃৎপিন্ড সংযােজন করে।

০১. আছে জন্ম, আছে মৃত্যু, আছে প্রাণ
চিত্র ১.৩: ডিসেম্বর ২, ১৯৮২ : বার্নি ক্লার্কের দেহে ইতিহাসে

প্রথমবারের মত যান্ত্রিক হৃৎপিন্ড সংস্থাপন। আশির দশকের প্রথম দিকে জেমি ফিস্কের ‘জীবন প্রাপ্তির উদাহরণটি আরেকটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ হিসেবে উঠে আসতে পারে পাঠকদের কাছে। এগারাে মাসের শিশু জেমি আর হয়ত বড়জোর একটা ঘন্টা বেঁচে থাকতে পারত-তার জন্মগত ত্রুটিপূর্ণ যকৃৎ নিয়ে। তার বাঁচবার একটিমাত্র ক্ষীণ সম্ভাবনা নির্ভর করছিল যদি কোন সুস্থ শিশুর যকৃৎ কোথাও পাওয়া যায় আর ওটি ঠিকমত জেমির দেহে সংস্থাপন করা সম্ভব হয়ে ওঠে। কিন্তু এতাে ছােট বাচ্চার জন্য কোথাওই কোন যকৃত পাওয়া যাচ্ছিলাে না। যে সময়টাতে জেমি ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢােলে পড়ছিলাে আর মৃত্যুর থাবা হলুদ থেকে হলুদাভ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিলাে সারা দেহে, ঠিক সে সময়টাতেই হাজার মাইল দূরে একটি ছােট্ট শহরে এক বিচ্ছিরি ধরণের সড়ক দুর্ঘটনায় পড়া দশ মাসের শিশু জেসি বেল্লোনকে হুড়াহুড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলাে। যদিও মাথায় তীব্র আঘাতের ফলে জেসির মস্তিষ্ক আর কাজ করছিলাে না, কিন্তু দেহের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোকে কিন্তু রেস্পিরেটরের সাহায্যে ঠিকই কর্মক্ষম করে রাখা হয়েছিলাে।

জেসির বাবা রেডিওতে দিন কয়েক আগেই একটি যকৃতের জন্য জেমির অভিভাবকদের আর্তির কথা শুনেছিলেন। শােকগ্রস্ত পিতা এতাে দুঃখের মাঝেও মানবিক কর্তব্যবােধকে অস্বীকার করেননি। তিনি ভেজিটেশনে চলে যাওয়া নিজের মেয়ের অক্ষত যকৃৎটি জেমিকে দান করে তাকে বাঁচানাের চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। জেসির রেস্পিরেটর বন্ধ করে দিয়ে তার যকৃৎ সংরক্ষিত করে মিনেসােটায় পাঠানাের ব্যবস্থা করা হল। জেমির বহু প্রতীক্ষিত অস্ত্রপ্রচার সফল হলাে। এভাবেই জেসির আকস্মিক মৃত্যু সেদিন জেমি ফিস্ককে দান করল যেন এক নতুন জীবন। সেই ধার করা যকৃৎ নিয়ে পুনর্জীবিত জেমি আজো বেঁচে আছে- পড়াশুনা করছে, দিব্যি হেসে খেলে বেড়িয়ে পার করে দিয়েছে জীবনের চব্বিশটি বছর!

এবার আসুন প্রিয় পাঠক – আপনাদের জিমি টন্টলিউজের ঘটনাটির সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। এক শুভ্র সকালে তরুণ জিমি লেক মিশিগানের উপর দিয়ে স্কেট করতে গিয়ে একস্তর পুরু বরফের আস্তরণ ভেদ করে হিমশীতল জলে তলিয়ে যায়। ও অবস্থাতেই ছিল সে অনেকক্ষণ। প্রায় আধাঘন্টা পরে পথচারীরা তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে। দেখে মনে হচ্ছিল জিমি মারাই গিয়েছে বুঝি, তার হৃৎস্পন্দন, নাড়ী, শ্বাসপ্রশ্বাস কিছুই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে গিয়ে সেবাশুশ্রুষার শুরু করার প্রায় একঘন্টা পরে ছেলেটির দেহে যেন জীবনের বৈশিষ্ট্য আবারাে নতুন করে ফিরে আসতে শুরু করলাে। আসলে ঠান্ডা পানির তীব্র ঝাপ্টা জিমির দেহকে একেবারে অসাড় করে দিয়েছিলাে। যদিও সাময়িক সময়ের জন্য হৃৎস্পন্দন এবং ফুসসুসও বন্ধ হয়ে গিয়েছিলাে, কিন্তু তার অন্যান্য প্রয়ােজনীয় অংগপ্রত্যংগগুলাে কিন্তু একটি মিনিমাম লেভেলে কাজ করে যাচ্ছিল।

সৌভাগ্যক্রমে সেই শক্তিটুকুই জিমির দেহে পুনরায় হৃৎস্পন্দন আর শ্বাসপ্রশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য ছিলাে যথেষ্ট। চিকিৎসকরা একমত যে, বরফ শীতল ঠান্ডা পানি অনেকক্ষেত্রেই ক্লোরোফর্মের মত অবচেতকের কাজ করে। আর তাই এ ধরণের পরিস্থিতিতে দীর্ঘক্ষণ কাটিয়েও বেঁচে যাবার উদাহরণ কিন্তু জিমি একা নয়। লাস ভেগাসের মুরে ব্রাউন আধাঘন্টা কিংবা উতাহ শহরে মিশেল ফাঙ্ক একঘন্টা ধরে বরফ-জলে ডুবে অচেতন হয়ে থাকবার পরও চিকিৎসকরা তাদের কিন্তু বাঁচাতে পেরেছেন।

Micheal frunk
চিত্র ১.৪: মিশেল ফাঙ্কঃ বরফ জলে দীর্ঘক্ষণ (৬৬ মিনিট) ডুবে থেকেও বেঁচে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ব রেকর্ড ; (ক) তার আড়াই বছর বয়সের ছবি (খ) এখনকার ছব

এবারে আসি মৃত্যুক্ষণের আলােচনায়। রােগীর মৃত্যুর সঠিক সময় নির্ধারণ করাটাও অনেকক্ষেত্রে অসুবিধাজনক, কারণ দেখা গেছে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেহের মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে, যেমন মস্তিষ্ক ৫ মিনিট, হৃৎপিন্ড ১৫ মিনিট, কিডনী ৩০ মিনিট, কঙ্কাল পেশী – ৬ ঘন্টা। অঙ্গ বেঁচে থাকার অর্থ হল তার কোষগুলাে বেঁচে থাকা। কোষ বেঁচে থাকে তৎক্ষণই যতক্ষণ এর মধ্যে শক্তির যােগান থাকে। শক্তি উৎপন্ন হয় কোষের অভ্যন্তরস্থ মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে। মাইটোকন্ড্রিয়ার কার্যকারিতা ক্ষুন্ন হলে কোষেরও মৃত্যু হয়। কাজেই বােঝা যাচ্ছে যে, মৃত্যু কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি প্রক্রিয়া। দেহের মৃত্যু দিয়ে এর প্রক্রিয়া শুরু হয়, শরীরের শেষ কোষটির মৃত্যু পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া চলতে থাকে।


 মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে

শেয়ার করুন —
5 2 votes
Post Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
মন্তব্য করুনx
()
x
Scroll to Top
Scroll to Top
১ম অধ্যায়

২য় অধ্যায়

৩য় অধ্যায়

৪র্থ অধ্যায়

৫ম অধ্যায়

৬ষ্ঠ অধ্যায়

৭ম অধ্যায়

৮ম অধ্যায়

৯ম অধ্যায়

গ্রন্থ আলোচনা/সমালোচনা